২০২৪ সালের ৫ আগস্টের জনঅভ্যুত্থান, যা পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অবনতিশীল ও অস্থিতিশীল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে—মোব সহিংসতা, চাঁদাবাজি এবং অসংগঠিত গোষ্ঠীর উত্থান বেড়ে গেছে। পুলিশ বাহিনী, যারা পূর্বে শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত ছিল, অভ্যুত্থানের পর তাদের দায়িত্ব থেকে অনেকটাই সরে দাঁড়ায়। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিশোধপরায়ণতা পুলিশ সদস্যদের ওপর নেমে আসে।
এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো—কিভাবে পুলিশ বাহিনীর কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করা যায় এবং একইসাথে বিকল্প পদক্ষেপ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার ঘাটতি পূরণ করা যায়। এই প্রবন্ধে পুলিশ বাহিনীর মনোবল পুনর্গঠনের কৌশল এবং জনগণনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা করা হয়েছে।
পুলিশে আস্থা ফিরিয়ে আনা
জনঅসন্তোষ ও প্রতিশোধের ভয়ে অনেক পুলিশ সদস্য এখনও দায়িত্বে ফিরতে অনীহা প্রকাশ করছেন, বিশেষত যারা রাষ্ট্রীয় দমন-নীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সংকট সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো—সৎ ও আইন মেনে চলা পুলিশদের অন্যদের অপরাধের দায় থেকে মুক্ত রাখা।
পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সরাসরি সংলাপ জরুরি। এজন্য উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সব থানায় সিনিয়র কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী সংগঠন ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দিনব্যাপী কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। এতে পুলিশ তাদের উদ্বেগ প্রকাশের সুযোগ পাবে এবং জনগণ ও পুলিশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠিত হবে।
ঐতিহ্যবাহী সমাজভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবন
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা নিরাপত্তা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ছিল। গ্রামের চৌকিদাররা পাহারা দিত, আবার গ্রামবাসীও পালা করে নিরাপত্তা দিত। এটি ছিল এক ধরনের সামষ্টিক দায়িত্ববোধ।
সময়ের সাথে সাথে আধুনিক প্রশাসন এই কাঠামোকে দুর্বল করেছে। তবে সমাজভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ধারণা এখনও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর নাগরিকরা দ্রুত সংগঠিত হয়ে নিজেদের এলাকা পাহারা দেয়, এমনকি দুর্গাপূজার সময় হিন্দু মন্দির পাহারা দিয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করে। এটি দেখায় যে জনগণনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও কার্যকর হতে পারে।
কমিউনিটি পুলিশিং ও নাগরিক প্রতিরক্ষা কৌশল
কমিউনিটি পুলিশিং ও নাগরিক প্রতিরক্ষা কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় এগুলো সফলভাবে কার্যকর হয়েছে। মিসরের ২০১১ সালের বিপ্লবের সময় পুলিশ সরে দাঁড়ালে জনগণ “জনগণ কমিটি” গড়ে লুটপাট ঠেকায়। নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের বিরুদ্ধে সেনাদের সহযোগিতায় ২৬,০০০ জন নিয়ে গঠিত “সিভিলিয়ান জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স (CJTF)” কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশেও পুলিশ ভেঙে পড়ার পর আনসার বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাহারা দেয়, যেমন থানাসমূহ, ট্রাফিক জংশন, এমনকি ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গ্রামে ভি.ডি.পি (VDP) সংখ্যালঘুদের রক্ষা করে এবং শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও রাত্রিকালীন পাহারায় ভূমিকা রাখে।
এগুলো প্রমাণ করে যে সঠিক প্রেরণা ও সংগঠনের মাধ্যমে জনগণ অস্থায়ীভাবে হলেও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম।
বহুমাত্রিক নিরাপত্তা কাঠামো
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং কাঠামো থাকলেও সরকারি সহায়তার অভাবে তা অকার্যকর। ২০০৬ সালের গ্রাম পুলিশ আইন চৌকিদারদের ইউনিয়ন পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করলেও তাদের ভূমিকা সীমিত। অন্যদিকে, আনসার ও ভিডিপি শহর ও গ্রামে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
একটি জনগণনির্ভর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুলিশ, আনসার-ভিডিপি এবং সেনাবাহিনী—সবার জন্যই উপকারী হতে পারে যদি সঠিকভাবে সমন্বিত হয়। পুলিশ আইনগত দায়িত্বে, আনসার-ভিডিপি মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তায় এবং সেনাবাহিনী জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার বাহিনী হিসেবে থাকলে একটি কার্যকর কাঠামো তৈরি হবে।
প্রধান পদক্ষেপসমূহ হতে পারে:
- সিভিল ডিফেন্স ইউনিট গঠন – গ্রাম পুলিশ, ভিডিপি, বিএনসিসি ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে।
- নিয়মিত টহল – হালকা অস্ত্রে সজ্জিত আনসার ও পুলিশ মহাসড়ক ও পরিবহন রুটে টহল দেবে।
- দ্রুত প্রতিক্রিয়া দল – সেনা, বিশেষ পুলিশ ও অস্ত্রসজ্জিত আনসারকে কৌশলগতভাবে মোতায়েন করে টহলদলের তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করা।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ একটি বড় বাধা। রাজনৈতিক দলগুলো আশঙ্কা করতে পারে—কমিউনিটি পুলিশিং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। এছাড়া স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো নিরাপত্তার নামে প্রতিপক্ষকে দমন করতে পারে। তাই স্বচ্ছ নজরদারি ও নিরপেক্ষ মনিটরিং জরুরি।
আন্তর্জাতিকভাবে দেখা গেছে, জনগণকে আইন-শৃঙ্খলায় যুক্ত করলে কখনও কখনও গণপিটুনির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেমন নাইজেরিয়ার CJTF অনেক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। তাই কঠোর নিয়ম, নজরদারি ও জবাবদিহি অপরিহার্য।
সর্বোপরি, এই কৌশল সফল করতে হলে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও অরাজনৈতিক নাগরিক সংগঠনের সমর্থন প্রয়োজন। একটি সুসংগঠিত সিভিল ডিফেন্স ব্যবস্থা শুধু আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে না, বরং পুলিশ-জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং একটি অধিকতর স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে—যা শান্তিকাল, সংকটকাল ও নির্বাচনী সময়—সবক্ষেত্রেই সমান কার্যকর হবে।