জুলাই–আগস্টের উত্তাল সময় শুধু একটি নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের সংগ্রাম ছিল না। এটি রূপ নিয়েছিল মানুষের মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকারে এক অনন্য গণজাগরণে। রংপুরে শহিদ আবু সাইদের বুক পেতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য সেই আন্দোলনের আগুনকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা ক্ষোভ ও বঞ্চনার বিস্ফোরণ ঘটেছিল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।
ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও জনবিচ্ছিন্নতা
২০০৮ সালে সামরিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। দুর্নীতি, লুটপাট এবং প্রতিহিংসা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা পর্যন্ত তোষামোদে মেতে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট ও ইতিহাস বিকৃতির এক বিপজ্জনক প্রবণতা সমাজে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে।
‘উন্নয়নের রোল মডেল’ নামের আবরণের আড়ালে গড়ে ওঠে দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারের ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি। নেতাদের কাছে জনগণ ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে ওঠে। ভোটারদের মতামত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে—নৌকা প্রতীকই যেন ছিল একমাত্র নিশ্চয়তা।
নির্বাচন ব্যবস্থা ও বিরোধী দমননীতি
২০১৪ সালে বিরোধী দলকে মাঠচ্যুত রেখে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন। তার পরবর্তী বছরগুলোতে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিরোধীদের দমন করার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ভোট হয় রাতের আঁধারে, আর ২০২৪ সালে ভোট হয় আওয়ামী লীগের নিজের ভেতরের ক্রীড়ায়। জনগণের মৌলিক ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দেশ পরিণত হয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের পরীক্ষাগারে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর অমানবিক নির্যাতন এবং সাজানো মামলার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলে। একই ধারাবাহিকতায় বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-নিপীড়ন চালানো হয় অভাবনীয় মাত্রায়।
উন্নয়ন বনাম জীবনমান
স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেলসহ বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও জনজীবনে সেই সুফল প্রতিফলিত হয়নি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি, আয়–ব্যয়ের অমিল, বেকারত্ব ও দুর্নীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। আয়ুদের ‘উন্নয়ন দশক’-এর মতো এক ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি হয়—যেখানে উন্নয়ন হয়েছিল উপরতলায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন থেকে ভোটাধিকার ও ন্যায্য অংশগ্রহণ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান
অবশেষে জমে থাকা ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা—সর্বস্তরের ছাত্রসমাজের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমিক, নারী, শিক্ষক, পেশাজীবী ও সংখ্যালঘুরা। বাম, ডান, মধ্যপন্থি সব রাজনৈতিক ধারার মানুষ একত্রিত হয়ে জনবিক্ষোভে অংশ নেয়।
শাসকের ‘রাজাকার নাতিপুতি’ আখ্যা দেওয়া সেসব শিক্ষার্থীরাই হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তির অগ্রদূত। দুই সহস্রাধিক প্রাণের শাহাদতের বিনিময়ে তারা প্রতিষ্ঠা করে গণমানুষের শক্তির বিজয়।
উপসংহার
অবশেষে প্রমাণিত হলো—দেশের প্রকৃত মালিক জনগণ। স্বৈরাচারী শাসন, যত শক্তিশালীই হোক না কেন, জনতার ঐক্য ও দৃঢ়তায় পরাজিত হয়েই ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ২০২৪ সালের গণআন্দোলন শুধু শেখ হাসিনার পতন নয়; এটি ছিল জনগণের অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ, যা দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেয় জনগণের হাতে।