গণতন্ত্র রক্ষায় নাগরিকের জাগরণই সবচেয়ে বড় শক্তি

গণতন্ত্র একটি ব্যবস্থার নাম মাত্র নয়, এটি একটি চেতনা, একটি দৈনন্দিন অভ্যাস, যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলেই গড়ে তোলে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকেই সরকারের সদিচ্ছার দিকে চেয়ে থাকেন, কেউবা আন্তর্জাতিক মিত্রদের হস্তক্ষেপ আশা করেন। কিন্তু গণতন্ত্রের আসল রক্ষক হচ্ছে সাধারণ জনগণ। তারা যদি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হয়, যদি তারা প্রশ্ন না তোলে, প্রতিবাদ না করে, তাহলে কোনো প্রশাসনিক পরিবর্তনই দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক চর্চা বজায় রাখতে পারবে না।

গণতন্ত্র শুধু ভোট নয়

প্রতিবার নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই আমরা সবাই উৎসাহী হই, কে জিতবে, কে হারবে, কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কে—এসব নিয়ে আলোচনা করি। অথচ গণতন্ত্র মানে শুধু ব্যালট বাক্সে ভোট দেয়া নয়। এটি হচ্ছে প্রতিদিনের জীবনচর্যায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো। যখন কেউ দুর্নীতি করে, তখন যদি জনগণ চুপ থাকে—তবে সে দুর্নীতির অংশীদার হয়ে যায়। যখন কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আর প্রতিবেশীরা নীরব থাকে—তখন সেই নীরবতা গণতন্ত্রের পরাজয়ের নামান্তর।

সচেতন নাগরিক মানেই শক্তিশালী সমাজ

গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে নাগরিক অংশগ্রহণ। এটি শুধু প্রতিবাদে অংশ নেওয়া বা সংবাদে মন্তব্য করা নয়, বরং প্রতিটি বিষয়ে নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে জানাশোনা রাখা। যে নাগরিক জানে তার করের টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে, যে প্রশ্ন তোলে হাসপাতালের দুরবস্থার জন্য, যে বাবা স্কুলে গিয়ে সন্তানের শিক্ষকের জবাবদিহি চায়, সেই হচ্ছেন প্রকৃত গণতান্ত্রিক নাগরিক। আজকের বিশ্বে তথ্যের অবাধ প্রবাহ আমাদেরকে একটি বড় সুযোগ দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল কিংবা ইউটিউব—এসব প্ল্যাটফর্মে যে কেউ গণতন্ত্র নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারে। প্রশ্ন করতে পারে, বিশ্লেষণ করতে পারে, ভুল তথ্য ধরিয়ে দিতে পারে।

নাগরিকের নীরবতা মানেই স্বৈরাচারের সুযোগ

ইতিহাস সাক্ষী, যেখানে জনগণ নিরব থেকেছে, সেখানে স্বৈরাচার মাথা তুলেছে। রাজনীতিকরা বা শাসকরা সুযোগ নেয় জনগণের উদাসীনতার। যখন মানুষেরা ভোট দেয়ার পর পাঁচ বছর মুখ বন্ধ রাখে, তখন ক্ষমতাবানরা নিজের মতো করে শাসন চালায়। একটি সমাজে যদি প্রতিটি নাগরিক নিজ অবস্থান থেকে জবাবদিহি দাবি করে, তবে কেউই আইন বা নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। গণতন্ত্র তখনই বেঁচে থাকে, যখন নাগরিকরা প্রশ্ন করে, ভুল ধরিয়ে দেয়, এবং সর্বোপরি, নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে।

কীভাবে সক্রিয় নাগরিক হওয়া যায়?

১. নিজের অধিকার ও দায়িত্ব জানুন: সংবিধান, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, আইন-কানুন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখুন।

২. ভুলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান: অফিসে, রাস্তায়, স্কুলে—যেখানেই অনিয়ম দেখবেন, প্রতিবাদ জানান। একা না পারলে সামাজিকভাবে একত্রিত হন।

৩.গণমাধ্যম ও তথ্যের উৎস যাচাই করুন: ভুল তথ্য গণতন্ত্রকে নষ্ট করে। সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য জানুন এবং অন্যদেরও জানান।

৪. ভোট দিন এবং ভোটের আগে প্রার্থী যাচাই করুন: কে আপনাকে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করবে, কে শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে রাখবে—তা বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।

৫. স্থানীয় উদ্যোগে অংশ নিন: পাড়া বা এলাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুন, সমাধান খুঁজুন, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।

উপসংহার: দায়িত্বের গর্ব হোক গণতন্ত্রের প্রেরণা

গণতন্ত্র কেবল একটি রাজনৈতিক কাঠামো নয়, এটি একটি মানসিক প্রস্তুতি, একটি সামাজিক সংস্কৃতি। সেখানে মানুষ শুধু শাসনের অধীন নয়, শাসন ব্যবস্থার গঠন ও পরিচালনায় সক্রিয় অংশীদার। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, জনগণের জাগরণ যখন সংগঠিত হয়, তখন স্বৈরতন্ত্রের পতন অনিবার্য। অতএব, আসুন আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল নাগরিক হই। আসুন, সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের পক্ষে প্রতিদিনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলোতে সক্রিয় থাকি। তবে তবেই আমরা একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *