জাতীয় ঐক্য: স্থিতিশীলতাএবং সংস্কারের একমাত্র পথ

আগস্ট ২০২৪, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা একটি পরিবার; আমাদের লক্ষ্য একটাই—একটি উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা”। ড. ইউনূস আশঙ্কা করেছিলেন, যদি জাতীয় ঐক্য ভেঙে পড়ে, তবে গণঅভ্যুত্থানের অর্জন নষ্ট হবে। বর্তমানে সেই আশঙ্কাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সংঘাতের ফাঁদ (কনফ্লিক্ট ট্র্যাপ): একটি দুস্ট চক্র

অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর, ক্ষুদ্র স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত ১৭০টিরও বেশি আন্দোলন জনজীবনকে অতিষ্ঠ করেছে । সকলেই অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল মনে করে, কারণ তাদের পেছনে জনসম্পৃক্ত কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক সংঘটন নেই। আন্দোলনকারীরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দাবি আদায়ের প্রচেষ্টায় লিপ্ত—এমন এক সময়ে যখন জাতীয় ঐক্য ও সরকারকে ঝামেলামুক্ত রাখা ছিল সকল মহলের দায়িত্ব।

“স্বাধীনতার চেতনা,” “বাঙালি বনাম বাংলাদেশি,” বা “ভারতপন্থী বনাম পাকিস্তানপন্থী” ইত্যাদি বিভাজক ধারণা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে-স্বাধীনতার পর থেকেই। অক্সফোর্ডের উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ পল কোলিয়ার এ ধরনের পরিস্থিতিকে “কনফ্লিক্ট ট্র্যাপ” বা সংঘাতের ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করেছেন—যখন কোনো সমাজ এই চক্রে পতিত হয়, তখন তার উন্নয়নের সব পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

যদিও ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভৌগোলিক সংহতির দিক থেকে দেশের মানুষের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে বড় কোনো পার্থক্য নেই, তথাপি রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পার্থক্যগুলোকে কৃত্রিমভাবে বড় করে তোলা হয়েছে। এই বিভাজন বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর থেকেই এক অস্থিরতা এবং স্থবিরতার আবর্তে নিক্ষেপ করেছে, যা আজও চলমান।

বর্তমান সংকট: বিগত সরকার দেশের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থাকে এক ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর অকার্যকারিতার ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এবং চাঁদাবাজি রোধ করা এখনও সম্ভব হয়নি। লাগাতার দাবি-দাওয়া ও সড়ক অবরোধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন যে এটি দেশকে স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সে আশার প্রদীপ অনেকটাই নিভে গেছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা সাম্প্রতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সরকার, রাজনৈতিক দল নাগরিক: একটি সম্মিলিত দায়িত্ব

রাজনৈতিক দার্শনিকরা বলেন সরকার আইন প্রয়োগ করলেও নাগরিকদের দায়িত্ব আইন মেনে চলা, সঠিক কাজ করা এবং প্রয়োজনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে  সরকারের সহযোগিতা করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হলো রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে সহযোগিতার পথ সহজ করা এবং সঠিক পরামর্শ দিয়ে সরকারকে সাহায্য করা। বর্তমান সংকট সমাধানের জন্য তিন পক্ষকেই একত্রে কাজ করতে হবে।

সরকারের ভূমিকা: অন্তর্বর্তী সরকার একটি দুর্বল রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছে, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচারব্যবস্থা ও সরকারি প্রশাসন পূর্ববর্তী শাসকের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের জন্য ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন, যা স্বল্পমেয়াদে সম্ভব নয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে, নির্বাচনের আগে সরকারকে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও প্রধান স্বার্থগোষ্ঠীসহ খোলামেলা আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ এবং জাতীয় নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ জনসম্মুখে ঘোষণা করতে হবে। মনে হচ্ছে সরকার সে পথেই এগুচ্ছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে, দেশ যে আইন-শৃঙ্খলা সমস্যার সম্মুখীন, তা থেকে উত্তরণের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজন। আমাদের দেশের পুলিশ-জনসংখ্যার অনুপাত প্রতি হাজারে ১.২ জন, যা স্বাভাবিক সময়ের জন্যও অপ্রতুল। যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ২.৪ এবং ভারতে ১.৫৩। তাই, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান সদস্য সংখ্যার সাথে আরও ৮০,০০০ সদস্য যোগ করা প্রয়োজন। যেহেতু এই কাজটি সহসা সম্ভব নয়, তাই বর্তমানে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অন্যান্য শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী মাঠে নামাতে হবে।

সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে নামানো হয়েছে, তবে তাদের সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। দেশের অন্যান্য বাহিনী, যেমন আনসার, ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি (ভিডিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি), এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পুলিশকে সহায়তার জন্য নিয়োজিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্যারামিলিটারি বাহিনীর সংখ্যা প্রায় ৫৮ লাখ, যা পৃথিবীর বৃহত্তম। শুধুমাত্র ভিডিপির সদস্যই সংখ্যা ৫৬ লাখ। এটি একটি তৃণমূল সংগঠন হওয়ায় উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ বাহিনীর সহায়ক ভূমিকায় সবচেয়ে উপযুক্ত।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কর্মদক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, এখন তাদের কার্যক্ষমতা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যারা প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সাফল্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের স্থলে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এছাড়া, উপদেষ্টাদের সংখ্যা অপ্রতুল—তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে একজনকে শুধুমাত্র একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।

রাজনৈতিক দল সুশীল গোষ্ঠী: রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের মৌখিক সমর্থনের ঊর্ধ্বে উঠে সরকারকে সক্রিয় ভাবে সহায়তা করতে হবে। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা অত্যন্ত যৌক্তিক, তবে তার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সমাধানে তাদের সক্রিয় ভুমিকা প্রয়োজন—আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির উন্নতি এর একটি। এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের নয়—এটি সকল মানুষের-আর রাজনৈতিক দলগুলি সকল মানুষের প্রতিনিধি।

দুর্গাপূজার সময় হিন্দু মন্দির রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। একই ধরনের মডেলে চাঁদাবাজি, দোকান ও হাইওয়েতে ডাকাতি, কিশোর গ্যাংয়ের কার্যকলাপ ইত্যাদি প্রতিরোধের জন্য দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্বের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং এর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে অতিরিক্ত সুবিধা হবে: দল গুলির জনসমর্থন বাড়বে, যা পরবর্তী নির্বাচনে তাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ছাত্র সংগঠন, আমলা, পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনের সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং সড়ক অবরোধের কর্মকাণ্ড বৃহৎ জাতীয় স্বার্থের চেয়ে সংকীর্ণ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের জনসম্পৃক্ততা ও যোগাযোগ ব্যবহার করে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে এসব দাবির মধ্যস্থতা করতে পারে, যাতে ক্ষুদ্র স্বার্থ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ঘোলাটে না করে।

যদি দলগুলো দাবি করে যে তাদের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, তবে তাদের মাঠে কাজ করে তা প্রমাণ করতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে তাদের দেশপ্রেম, জনসম্পৃক্ততা এবং ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে সকলের মনে সন্দেহের উদ্রেক হবে, যার প্রতিফলন পরবর্তী নির্বাচনে তাদেরই ভোগ করতে হবে।

ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাম্প্রতিক পরিবর্তনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এবং এখন নির্ধারণ করতে হবে সামনের দিনগুলোতে তাদের কর্মপন্থা কী হবে। সরকারি সমর্থনে একটি দল গঠন করা হলে, তা অতীতের ভুলগুলোরই পুনরাবৃত্তি হবে—যা কারও কাছেই কাম্য নয়। বরং তাদের উচিত দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেশের মূল সমস্যাগুলোর সমাধানে এগিয়ে আসা। যে কোনো দেশেই সবচেয়ে কার্যকর সংস্কার হলো দেশের সাধারণ মানুষকে “সক্রিয় নাগরিক” হিসেবে তৈরী করা। যদিও এটি একটি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, এর বাইরে কোনো সংস্কারই স্থায়ী সমাধান নয়।

একটি নতুন ধারার রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি, অবিচার, সকল পর্যায়ের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নাগরিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ভোট ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝাতে হবে এবং ক্লায়েন্ট-পেট্রন নেতৃত্বের ধারা ও দলীয় অন্ধ আনুগত্যের বাইরে এসে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য গণমানুষকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এই গুরুদায়িত্ব কেবল বিরোধী অবস্থানে থেকেই সম্ভব, ক্ষমতায় থেকে নয়—এটাই হওয়া উচিত নবীন তরুণদের পাথেয়।

উপসংহার: স্থিতিশীলতার জন্য সম্মিলিত দায়িত্ব

বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে। ৫ আগস্ট আন্দোলন কাঠামোগত সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু এটি অর্জন করতে হলে সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দোষারোপের সাংস্কৃতি এই সংকট সমাধান করবে না। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সম্মিলিত দায়িত্ব, কৌশলগত সংস্কার ও ঐক্যের প্রতিশ্রুতির ওপর। যদি অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়, তবে তা শুধু তাদেরই ব্যর্থতা হবে না—এটি হবে রাজনৈতিক শ্রেণি, সুশীল সমাজ ও জনগণের সম্মিলিত ব্যর্থতা। শুধুমাত্র একটি ঐক্যবদ্ধ, বাস্তববাদী পদ্ধতিই বাংলাদেশকে সংঘাত ও বিভাজনের চক্র থেকে মুক্ত করতে পারে। এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *