কিউবার উপকূলঘেঁষা এক ছোট্ট জেলেপল্লিতে থাকতেন এক বৃদ্ধ জেলে, যার নাম সান্তিয়াগো। তার মুখ ছিল সমুদ্রের সঙ্গে বছরের পর বছর লড়াইয়ের চিহ্নে বিবর্ণ ও রেখাঙ্কিত, আর তার হাতজোড়া ছিল অসংখ্য মাছ ধরা ও যুদ্ধের ক্ষতচিহ্নে পূর্ণ। একসময় তার দক্ষতার জন্য মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু এক সময় সবাই তাকে অভাগা বলে মনে করত কারন টানা চুরাশি দিন ধরে সে একটিও মাছ ধরতে পারেনি, ফলে মানুষ তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। শুধু মানোলিন নামের এক কিশোর, যে আগে তার সঙ্গে মাছ ধরত তাকে শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। কিন্তু মানোলিনের বাবা-মা তাকে বাধ্য করেছে অন্য সফল জেলেদের সঙ্গে যেতে, তাই সান্তিয়াগোকে একাই সমুদ্রে যেতে হত।
সব দুর্ভাগ্যের পরও সান্তিয়াগো আশাবাদী ও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরবর্তী যাত্রা হবে ভিন্ন। অনেক চেস্টার পরও তিনি পর পর কিছুই ধরতে পারেন নি। পঁচাশি তম দিনে, ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি নিজের ছোট্ট নৌকাটি প্রস্তুত করলেন এবং দূর সমুদ্রে রওনা হলেন, অন্য জেলেদের চেয়েও অনেক দূর। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভাগ্য সাহসীদের পক্ষেই থাকে, এবং নিজের যৌবনের শক্তি ও দক্ষতা প্রমাণ করতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টায় প্রস্তুত ছিলেন।
সমুদ্র ছিল শান্ত, এবং সান্তিয়াগো নিজেকে এর বুকে ঘরের মতো স্বচ্ছন্দ বোধ করলেন। তিনি সমুদ্রকে ভালোবাসতেন, স্প্যানিশ ভাষায় তাকে ডাকতেন “লা মার”, এক নারীর মতো—সুন্দর, রহস্যময় ও দয়ালু, তবে কখনও নিষ্ঠুরও হতে পারে। তিনি পাখি, উড়ন্ত মাছ আর ঢেউয়ের চলাচল দেখে প্রকৃতির সংকেত পড়ছিলেন, যেন একটি খোলা বইয়ের মতো। মনে হচ্ছিল তিনি সমুদ্রের সঙ্গে কথোপকথন করছেন, তার শক্তিকে সম্মান জানাচ্ছেন, তবে ভয় পাচ্ছেন না।
সকালের মাঝামাঝি তিনি অনুভব করলেন তার মাছ ধরার ছিপে একটি প্রবল টান—একটি বিশাল মাছ টোপ গিলেছে। সান্তিয়াগো সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলেন, এটি সাধারণ কোনো মাছ নয়। ছিপের সুতার টান তার হাতের তালুতে ক্ষত সৃষ্টি করল, আর তিনি টের পেলেন, একটি দৈত্যাকৃতি মারলিন মাছ ধরেছেন, যা তার নৌকার চেয়ে বড় এবং যত মাছের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করেছেন, তাদের চেয়ে শক্তিশালী। মাছটিকে টেনে আনার চেষ্টা না করে, তিনি মাছটিকে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে দিলেন, আর নিজে প্রাণপণে ছিপ ধরে রাখলেন। শুরু হল এক প্রবল মানসিক লড়াই, তিনদিন তিনরাতের কঠিন সংগ্রাম।
সময় পার হতে থাকল। সান্তিয়াগো একা, কখনও নিজেকে, কখনও মাছকে, কখনও সমুদ্রের সাথে কথা বলতেন। তিনি মারলিনটিকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন, তার শক্তি ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতেন। মাছটির সঙ্গে তার গভীর এক সম্পর্ক অনুভূত হয়, তবে তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে মাছটিকে ধরার দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও হাতের ব্যথা সত্ত্বেও, সান্তিয়াগো ছিপি ছাড়েননি। তিনি স্মরণ করলেন তার যৌবনের দিনগুলো, যখন তিনি চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে কুস্তি করতেন, আর সেই স্মৃতিগুলোই তাকে মানসিক শক্তি জোগায়।
তৃতীয় দিনে, সান্তিয়াগো অবশেষে মারলিনটিকে নৌকার কাছে টেনে আনতে সক্ষম হলেন। এক চূড়ান্ত প্রচেষ্টায়, তিনি হারপুন দিয়ে মাছের হৃদয়ে আঘাত করলেন। মারলিনটি ছটফট করে, রক্তে সমুদ্র রঞ্জিত করে, অবশেষে নিথর হল। সান্তিয়াগোর মনে জয় ও দুঃখ মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতি হল। তিনি বিশাল মাছটিকে পরাজিত করেছেন, কিন্তু মাছটির প্রতি তার শ্রদ্ধা এত গভীর যে তিনি উল্লাস করতে পারলেন না। তিনি মাছটিকে নৌকার পাশে বেঁধে নিলেন, কারণ এটি ভিতরে ধরার মতো নয়, আর গর্বিত ও ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরতে শুরু করলেন।
কিন্তু জয়ের মূল্য ছিল চরম। ফেরার পথে, মারলিনের রক্তে আকৃষ্ট হয়ে শার্কের দল আক্রমণ করল। প্রথমে একটি বিশাল মাকো শার্ক আক্রমণ করল, সান্তিয়াগো তা হারপুন দিয়ে হত্যা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে শার্কটি মাছের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলেছে। তারপর একে একে আরও শার্ক এল। তিনি ছুরিকে বৈঠায় বেঁধে, তারপর একটি লাঠি দিয়ে, শেষে নৌকার হাল দিয়ে শার্কদের প্রতিহত করলেন। তিনি অনেক শার্ক মারলেন, তবু তারা থামল না। প্রত্যেক আক্রমণে মারলিনের অংশ ছিঁড়ে নিতে লাগল, অবশেষে শুধু কঙ্কালটুকু বাকি থাকল।
যখন সান্তিয়াগো উপকূলে পৌঁছালেন, তখন রাত হয়েছে, আর তিনি সম্পূর্ণরূপে অবসন্ন। তার হাত কাটা ও রক্তাক্ত, পিঠে যন্ত্রণা, হাঁটতে পারছিলেন না। তিনি নৌকা ও মারলিনের ধ্বংসাবশেষ ছেড়ে ক্লান্ত দেহে কুঁড়েঘরে ফিরে এলেন এবং বিছানায় পড়ে গেলেন। পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা তার নৌকার চারপাশে ভিড় জমাল, মারলিনের কঙ্কালের বিশালতা দেখে অবাক হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল, সান্তিয়াগো এক কিংবদন্তি আকৃতির মাছ ধরেছিলেন, মাংস না থাকলেও তার সম্মান পুনরুদ্ধার হয়েছে।
মানোলিন, যিনি সান্তিয়াগোর জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন, তার কুঁড়েঘরে এলেন ও দেখলেন তিনি ঘুমিয়ে আছেন। বৃদ্ধের আঘাতপ্রাপ্ত হাত ও ক্লান্ত দেহ দেখে কিশোর কেঁদে ফেলল, এবং শপথ করল, পিতামাতার কথা না শুনে আবার সান্তিয়াগোর সঙ্গে মাছ ধরবে। সান্তিয়াগো মাছ হারালেও আরও বড় কিছু জয় করেছেন—সম্মান, মর্যাদা ও অদম্য মনোবল।
সান্তিয়াগো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আফ্রিকার সমুদ্রতটে সিংহদের স্বপ্ন দেখলেন—যুবা বয়সের স্মৃতি, শক্তির প্রতীক, সহিষ্ণুতা ও আশার চিহ্ন।