সাইফুর রহমান | সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে সামগ্রিক বেকারত্বের হার আপাতদৃষ্টিতে তুলনামূলক কম হলেও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা ক্রমবর্ধমান গুরুতর রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুযায়ী দেশের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার ১৩.১১% যা মোট জাতীয় বেকারত্বের হারের তুলনায় বেশ উঁচু (প্রায় ৫% এর কাছাকাছি)। গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা বেড়েছে; উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে যেখানে প্রায় ৪ লাখ উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী কর্মহীন ছিলেন, ২০২২ সালে এসে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ৮ লাখে পৌঁছেছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৮.২৪% – যা সামগ্রিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ । বিস্ময়করভাবে, বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের তুলনায় স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সর্বাধিক; ২০২২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস জনসংখ্যার মধ্যে বেকারত্ব ছিল ৮.৮৭%, মাধ্যমিক পাসদের মধ্যে মাত্র ২.৮২%, যেখানে তৃতীয় পর্যায় তথা স্নাতকদের মধ্যে এই হার ছিল আরও বেশি। এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে স্পষ্ট যে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেও বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না, যা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
মূল কারণসমূহ
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি মৌলিক কারণ চিহ্নিত করা যায়। নিচে প্রধান কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:
চাকরির বাজার ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অসঙ্গতি
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে চাকরির বাজারের চাহিদার বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে জ্ঞান ও ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে তার সাথে শিল্পক্ষেত্রে বাস্তব দক্ষতা ও জ্ঞান-এর মিল কম। ফলস্বরূপ, ডিগ্রি অর্জনের পর চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে গিয়ে গ্র্যাজুয়েটরা প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে । একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে নিয়োগদাতাদের চাহিদা ও চাকরিপ্রার্থীদের সক্ষমতার মাঝে বড় ফাঁক রয়েছে; আমাদের একাডেমিক পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট বাস্তব অভিজ্ঞতায় দক্ষ করে তুলছে না, ফলে নিয়োগদাতারা প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না। এই অসঙ্গতির কারণে অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি পাচ্ছেন না।
কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব
বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী কোন না কোন কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিয়োজিত থাকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মাত্র ৯% শিক্ষার্থী এই ধরনের বাস্তবমুখী শিক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এর ফলে একদিকে চাকরির বাজারে প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মীর অভাব দেখা দিচ্ছে, অন্যদিকে সনাতনী বিষয়ে স্নাতকদের আধিক্য সৃষ্টি হচ্ছে। আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদন শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে স্থানীয় দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানকে বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করতে হচ্ছে, যা অর্থনীতি থেকে সম্পদ পাচারের শামিল। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় নিয়োগদাতাদের ৯০% উল্লেখ করেছেন যে চাকরিপ্রার্থীদের কম্পিউটার ও ইংরেজি দক্ষতা অপরিহার্য, এছাড়া যোগাযোগ দক্ষতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে।
কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ ও বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব
বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক স্নাতক শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও তাদের উপযোগী কর্মসংস্থান তৈরির হার খুবই সীমিত। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি চাহিদার তুলনায় অনেক ধীর। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের জনসংখ্যা ও স্নাতকদের ক্রমবর্ধমান প্রবাহের তুলনায় সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও নতুন চাকরি সৃষ্টি পর্যাপ্ত হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশ কর্মহীন রয়ে যাচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও সেখানে অর্জিত ডিগ্রির বাস্তব মূল্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, আবার একই সাথে দেশে উচ্চমানের চাকরির সংখ্যা কম – এই “গুণগত শিক্ষা এবং গুণগত কর্মসংস্থানের অভাব” সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে। সহজভাবে বললে, যে হারে উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজ বের হচ্ছে, সেই অনুপাতে শিল্প ও সেবা খাতে নতুন চাকরির সৃষ্টি হচ্ছে না, যার ফলে বেকারত্ব স্থিতিশীল না থেকে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে পরিবর্তিত কর্মসংস্থান কাঠামো
আধুনিক যুগে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের দ্রুত অগ্রগতির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে অনেক প্রচলিত চাকরির ধরন পরিবর্তিত বা বিলুপ্ত হচ্ছে এবং নতুন ধরনের চাকরির চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের একটি প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অটোমেশনের কারণে প্রায় ৮.৫ কোটি চাকরি হারিয়ে যাবে এবং সাথে সাথে ৯.৭ কোটি নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দক্ষতা দাবি করবে। তাছাড়া, ২০৩০ সালের মধ্যে বর্তমানের মূল কর্মদক্ষতার প্রায় ৩৯% অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেমন তৈরি পোশাক শিল্পে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে নিম্ন দক্ষতার অনেক কাজ হ্রাস পেতে পারে, আবার আইটি, রোবোটিক্স, ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো খাতে নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি এই উদীয়মান পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ফলে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এই ধাক্কায় অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী চাকরির বাজারে নিজেদের অপ্রসঙ্গিক অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে, যাদের বিদ্যমান দক্ষতা নতুন চাকরির কাঠামোর সাথে খাপ খায় না। এটি উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের একটি উদীয়মান কারণ হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব কেবল ব্যক্তি বিশেষের সমস্যা নয়; এর গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে বেকার থাকার ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক ইঙ্গিত বহন করে। অনেক যুবক-যুবতী চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে মাদকাসক্তি বা অপরাধমূলক কার্যক্রমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে নিবন্ধিত মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রায় ৫৮% ছিল বেকার যুবক – যা দেখায় যে বেকারত্ব মাদক সমস্যাকে গুরুতরভাবে বৃদ্ধি করছে। বেকার তরুণরা আর্থিক চাপে পড়ে চুরি, ছিনতাই বা প্রতারণার মতো অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে, যা আইনশৃঙ্খলার জন্য উদ্বেগের বিষয়। এই পরিস্থিতি পরিবার ও সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলছে; পরিবারের উপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে।
একদিকে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে উচ্চশিক্ষা প্রদান করলেও সেই বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত উৎপাদনশীলতা ও দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। মূল্যবান মানবসম্পদ অকর্মণ্য থাকায় অর্থনীতির সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে বেকারত্ব বৃদ্ধি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঝুঁকি বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে । দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই যুবসমাজ; যদি তাদের যথাযথ কাজে লাগানো না যায়, তবে demographic dividend বা জনমিতিক সুবিধা পূর্ণভাবে অর্জিত হবে না বরং তা “demographic burden” এ পরিণত হবে। রাষ্ট্র পর্যাপ্ত হারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারাতে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা বিদেশমুখী হচ্ছে, Brain Drain ঘটছে – দেশ অভ্যন্তরীণভাবে দক্ষ জনবল হারাচ্ছে যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। সার্বিকভাবে, উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব সমাজে হতাশা ও অসন্তোষ জন্ম দিচ্ছে এবং অর্থনীতির অগ্রগতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে, যা দ্রুত সমাধান না করলে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর সংকটের রূপ নিতে পারে।
সম্ভাব্য সমাধান
উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে একাধিক দিক থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শ্রমবাজার পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সংস্কার ও উদ্ভাবনী পদক্ষেপ দরকার। নিচে কিছু সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয় দিক তুলে ধরা হলো:
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম
শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। একাডেমিক পাঠ্যক্রমে এমন পরিবর্তন আনতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, কর্মক্ষেত্রে দরকারি ব্যবহারিক দক্ষতাও অর্জন করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিল্প ও কর্পোরেট সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে যেন ছাত্ররা পড়াশোনার পাশাপাশি ইন্টার্নশিপ ও প্রকৃত কর্মঅভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। শিক্ষাক্রমে আধুনিক প্রযুক্তি, আইসিটি, যোগাযোগ দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও শ্রমবাজার সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেয়ার ব্যবস্থা রাখা জরুরি, যাতে তারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই কর্পোরেট বিশ্বের চাহিদা সম্পর্কে প্রস্তুত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চার বছরের অনার্স কোর্সকে তিন বছরে সম্পন্ন করে চতুর্থ বছরে ডিপ্লোমা বা কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি উদ্যোগ আলোচিত হচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে স্নাতকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও বহুলাংশে বাড়বে।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি
কর্মসংস্থান সংকট মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। নতুন শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে নীতিগত সুবিধা ও প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে দেশে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে (Public-Private Partnership) বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, অ্যাপ্রেন্টিসশিপ ও ইন্টার্নশিপ চালু করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আইটি পার্ক, হাইটেক পার্ক, স্পেশাল ইকোনমিক জোনগুলোতে কর অব্যাহতি, সহজ ঋণসহ অন্যান্য প্রণোদনা দিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে, যা উচ্চশিক্ষিতদের জন্য নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করবে। সরকার বিভিন্ন সেক্টরে Mega Project ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে স্বল্পমেয়াদে কিছু চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই চাকরির জন্য বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও শিল্পায়নের মাধ্যমে যখন অর্থনীতির বহুমুখীকরণ হবে, তখন স্নাতকদের জন্য উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্রও বেড়ে যাবে। এছাড়া, শ্রমবাজারের তথ্যভাণ্ডার তৈরির মাধ্যমে কোন খাতে কত জনবল দরকার এবং কোন দক্ষতার ঘাটতি আছে তা চিহ্নিত করে পরিকল্পনা নিতে হবে। মোটকথা, সরকারী নীতি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে একটি কর্মসংস্থান-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে উচ্চশিক্ষিতরা মেধা ও দক্ষতা অনুযায়ী সুযোগ পাবে।
উদ্যোক্তা তৈরি ও ফ্রিল্যান্সিং সুযোগের সম্প্রসারণ
সরকারি চাকরি বা ঐতিহ্যবাহী বেসরকারি চাকরির বাইরে বিকল্প কর্মসংস্থানের পথগুলি প্রসারিত করতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্টার্টআপ সংস্কৃতি বিকাশে সহজ শর্তে ঋণ, প্রযুক্তিগত পরামর্শ, ইনকিউবেশন সেন্টার ও কর অব্যাহতির মতো সুবিধা দেয়া যেতে পারে। নতুন ব্যবসা শুরু করে যদি এক একজন উদ্যোক্তা নিজে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেন, দীর্ঘমেয়াদে তা আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং খাত ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বহু শিক্ষিত তরুণের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ সরবরাহকারী দেশগুলোর একটি, যা প্রমাণ করে যে সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ পেলে আমাদের তরুণরা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। সরকারিভাবে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কো-ওয়ার্কিং স্পেস এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা বাড়িয়ে দিলে আরও বেশি যুবক-যুবতী ঘরে বসেই বৈশ্বিক ক্লায়েন্টদের জন্য কাজ করতে পারবে। এভাবে রপ্তানিমুখী সেবা খাত হিসেবে আইটি ও ডিজিটাল সেক্টরে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিকাশ একদিকে যেমন বেকারত্ব কমাবে, অন্যদিকে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করবে।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব বৃদ্ধি
শুধু সনাতনী সাধারণ শিক্ষার পেছনে ছোটা থেকে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা যেন মূলধারার শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়, সেজন্য সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ভুল ধারণা যে ভোকেশনাল বা টেকনিক্যাল শিক্ষা কম মর্যাদাপূর্ণ – এটি দূর করতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা ও নীতি সহায়তা প্রয়োজন। স্কুল ও কলেজ পর্যায় থেকেই কারিগরি প্রশিক্ষণের উপাদান যোগ করতে হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের এই পথে আসতে উৎসাহিত করতে হবে। অধিক পরিমাণে সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। একই সাথে, বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করতে হবে যাতে তারা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা কোম্পানির ভিতরেই কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা করে। যারা একাডেমিক উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী নয় বা উপযুক্ত নয়, তারা যেন বিকল্প হিসেবে মানসম্পন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে – এটার জন্য একটি স্পষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা চাই। জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে কারিগরি শিক্ষাকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে; বাংলাদেশেও অনুরূপভাবে সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতরা দ্রুত চাকরি পায় ও উদ্যোক্তা হতে পারে – সমাজে এই সফল উদাহরণগুলি তুলে ধরতে পারলে ধীরে ধীরে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হবে। সর্বোপরি, “উচ্চশিক্ষা মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি” – এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে “দক্ষতাই প্রকৃত শিক্ষা” – এই দর্শন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব দূরীকরণে আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরেও কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী সফল মডেলগুলো থেকে শেখা এবং আগামীর চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া – এই দু’টি দিকেই মনোনিবেশ করতে হবে।
উন্নত বিশ্বের মডেল থেকে শিক্ষা
উন্নত অর্থনীতিগুলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে যেসব কৌশল গ্রহণ করেছে সেগুলো আমাদের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন, জার্মানি ও বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে দ্বৈত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা (Dual Apprenticeship) চালু রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থী একই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এতে তাদের ডিগ্রির পাশাপাশি বাস্তব কর্মদক্ষতা অর্জিত হয় এবং ডিগ্রি শেষেই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে শিক্ষাক্রম নিয়মিত আপডেট করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তা ও সমস্যা-সমাধান শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়, যা চাকরিদাতারা মূল্য দেয়। উন্নত দেশে প্রায় ৬০-৭০% শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারিগরি বা ব্যবহারিক পাঠক্রমে যুক্ত থাকে, আমাদের এখানে সেই হার বাড়াতে পারলে দ্রুত সুফল মিলবে। তাছাড়া, উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও উদ্ভাবনের সাথে শিল্পকারখানার নিবিড় সম্পর্ক থাকে; বাংলাদেশেও ইউনিভার্সিটি রিসার্চ ও প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে নতুন পণ্য ও সেবা উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে, যা পরোক্ষভাবে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে। সংক্ষেপে, যেসব মডেল বিশ্বে বেকারত্ব মোকাবিলায় সফল (যেমন দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা, Apprenticeship, Career Counseling, Industry-Academia Collaboration), সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এগোতে হবে। এর পাশাপাশি অবশ্যই স্থানীয় বাস্তবতা অনুযায়ী সেই মডেলগুলোর সংস্করণ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে আমাদের সামাজিক-আর্থিক প্রেক্ষাপটে সেগুলো কার্যকর হয়।
এআই ও অটোমেশনের যুগে নতুন দক্ষতার চাহিদা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং, রোবোটিক্স ও স্বয়ংক্রিয়তার ব্যাপক প্রসার ঘটছে, যা ভবিষ্যতের চাকরির বাজারকে আমূল বদলে দেবে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে, নইলে আমাদের শ্রমশক্তি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বর্তমানে প্রয়োজনীয় অনেক দক্ষতা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে এবং নতুন ধরণের কাজের জন্য একেবারে নতুন দক্ষতা দরকার হবে। তাই শিক্ষার্থীদেরকে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান উপযোগী করতে Reskilling ও Upskilling ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আইটি, প্রোগ্রামিং, ডেটা সায়েন্স, ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে উচ্চশিক্ষিত যুবকদের পুনরায় দক্ষ করে তুলতে হবে। সরকারের a2i (Access to Information) কর্মসূচি বা GenU (Generation Unlimited) Bangladesh উদ্যোগের মতো প্রকল্পগুলো এরই মধ্যে লক্ষাধিক যুবকে আইসিটি ও উদীয়মান ক্ষেত্রের দক্ষতা দিতে কাজ শুরু করেছে। এসব উদ্যোগের পরিসর আরও বাড়াতে হবে এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি, শিক্ষকদেরও আধুনিক প্রযুক্তি ও শিক্ষাদান পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎমুখী দক্ষতা প্রদান করতে সক্ষম হন । কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশনের ফলে যে চাকরিগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সেই খাতের কর্মীদের বিকল্প দক্ষতা শেখানোর ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। একই সাথে, AI-বান্ধব নতুন চাকরি যেমন ডেটা অ্যানালিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার, রোবট মেইনটেন্যান্স, সাইবার সিকিউরিটি – এসবের জন্য দেশীয় মানবসম্পদ গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোর কারিকুলামে সংশোধন আনতে হবে। যদি আমরা আগামীর প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি, তাহলে AI যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উচ্চশিক্ষিত যুবকদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে সমন্বিত ও বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। বর্তমান পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে সমস্যাটি কাঠামোগত – শিক্ষা ব্যবস্থা, দক্ষতা উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও চাকরির বাজার একসঙ্গে জড়িত। তাই সমাধানও আসতে হবে সামগ্রিকভাবে। শিক্ষা কারিকুলামে যুগান্তকারী পরিবর্তন, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ এবং প্রযুক্তি-বান্ধব দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারি। নীতিনির্ধারকদের উচিত অবিলম্বে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যেখানে উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট কর্মসূচি ও লক্ষ্য নির্ধারণ থাকবে। কর্মক্ষম উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজ জাতির অমূল্য সম্পদ; সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পেলে তারাই অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। সুতরাং এখনই পদক্ষেপ নিয়ে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের “অদৃশ্য মন্দা” দূর করতে হবে এবং একটি দক্ষ, কর্মপ্রাণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। এতে শুধু ব্যক্তিগত উন্নতি নয়, সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব দূরীকরণ মানে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক, উৎপাদনশীল অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলা – যা আমাদের সবার অভীষ্ট লক্ষ্য। তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন এবং জাতির সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) ২০২৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপের ফলাফল – tertiary বা উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বেকারত্বের হার। সুত্র
শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এবং ২০১৭-২০২২ সময়কালে তার পরিবর্তন সুত্র ১ , সুত্র-২
BIDS-এর গবেষণায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের বেকারত্ব হার ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ সুত্র
উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের তুলনায় স্নাতকদের বেকারত্ব হার বৃদ্ধি পাওয়ার পরিসংখ্যান সুত্র
ডেইলি অবজারভার ও ডেইলি স্টার প্রতিবেদনে শিক্ষাবাজার ও চাকরিবাজারের অসঙ্গতি সংক্রান্ত বিশ্লেষণ এবং বিশেষজ্ঞ মতামত সুত্র-১, সুত্র-২
ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এবং বিজনেস পোস্ট-এর তথ্য হতে বেকারত্বের সামাজিক প্রভাব (মাদকাসক্তি ও অপরাধ) এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কিত পরিসংখ্যান সুত্র-১ , সুত্র-২
উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতার মধ্যে অসামঞ্জস্য নিয়ে BIDS ও IID এর গবেষণা উপাত্ত (নিয়োগদাতাদের চাহিদা, ডিগ্রিধারীদের পেশা-বহির্ভূত কর্মসংস্থান ইত্যাদি), সুত্র-১ সুত্র-২
সমাধান পর্যায়ে উল্লেখিত ব্যবস্থাসমূহের পক্ষে বিভিন্ন উৎসের তথ্য (ইত্তেফাক ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রস্তাবিত শিক্ষা সংস্কার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ, অবজারভার পত্রিকায় কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা) সুত্র
অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা সম্পর্কিত প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান সুত্র