ভূমিকা
স্বাধীনতা-উত্তর অনেক উন্নয়নশীল দেশ আজও রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রেণিবৈষম্য ও সামাজিক বিভাজনে ভুগছে। এসব সমস্যা শুধু উন্নয়নের গতি থামায় না, জাতিকেও ভেতর থেকে দুর্বল করে। কেন এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়? কারণ, এই দেশগুলোতে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে দূরদর্শী নেতৃত্ব। এমন নেতৃত্ব, যা অতীত ভুলে সবাইকে একত্রে চলার অনুপ্রেরণা দিতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে “জাতীয় ঐক্য” শুধু স্লোগান নয়, বরং শান্তি ও স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি।
রাজনৈতিক সংঘাত: উন্নয়নের বাধা
বহু দেশে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সংঘাত জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। উপনিবেশিক শাসনের রেশ, বৈষম্যমূলক অর্থনীতি ও পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি জাতিকে বিভক্ত করেছে। তাই নেতৃত্বে উঠে আসে না এমন কেউ, যিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন। ফলাফল—জাতীয় ঐক্যের অভাব ও বারবার সংঘাত।
বিপ্লবের পর পুনর্গঠন জরুরি
প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি নতুন সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু অনেক সময় বিজয়ী গোষ্ঠী প্রতিপক্ষ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে প্রতিশোধ, অবিশ্বাস ও বিভাজন বাড়ে। ফলে, জাতীয় পুনর্গঠন সম্ভব হয় না; সংঘাতই দীর্ঘস্থায়ী হয়।
চিলি: ঐক্য গঠনের দৃষ্টান্ত
১৯৭০-এর দশকে চিলি ভয়াবহ মেরুকরণের মধ্যে পড়ে। পিনোচের স্বৈরশাসনের পতনের পর প্রেসিডেন্ট রিকার্দো লাগোস নেতৃত্ব দেন ভিন্নভাবে। তিনি অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জাতিকে ঐক্যের আহ্বান জানান। তার উদ্যোগে গঠিত হয় ‘সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন’। এতে মানুষ কাঠামোগতভাবে ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায়। ফলাফল—চিলি ধীরে ধীরে ফিরে পায় স্থিতিশীলতা।
জাতীয় ঐক্যের মানে
জাতীয় ঐক্য মানে অন্যায়কে উপেক্ষা করা নয়। বরং ন্যায়বিচার থেকেই আস্থা গড়ে ওঠে। এই আস্থাই ভবিষ্যৎকে স্থিতিশীল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানও এমন নেতৃত্ব দেখিয়েছে। তারা অতীত শত্রুতা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলে। শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে তারা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক শক্তি। এটাই প্রমাণ করে, ঐক্য ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে।
প্রতিপক্ষ নিঃশেষ করার বিপদ
বহু দেশে বিজয়ী গোষ্ঠী পরাজিতদের নিঃশেষ করতে চায়। এই প্রবণতা সমাজকে করে অস্থির। আফ্রিকার অনেক দেশে সামরিক বিজয়ের পর গণদমন দেখা গেছে। এতে জন্ম নেয় গৃহযুদ্ধ ও বিদ্রোহ। বিজয় পরিণত হয় বিভাজনের নতুন চক্রে।
ঐক্যের জন্য দূরদৃষ্টি জরুরি
একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে কেবল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট নয়। দরকার জনগণের মনে আস্থা তৈরি করা। জনগণ যদি মনে করে তারা এক বৃহৎ স্বপ্নের অংশ, তবে আস্থা গড়ে ওঠে। এই স্বপ্নে থাকতে হবে ন্যায়, মানবিকতা ও সমঅধিকার। এমন নেতৃত্বই জাতিকে সংঘাতমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
নেতৃত্বের দায়িত্ব কী
নেতৃত্ব মানে শুধু নির্বাচন জেতা নয়। প্রকৃত নেতা জাতিকে ঐক্যের পথে ফিরিয়ে আনেন। শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভিতর দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তিনি পথ তৈরি করেন। বিভাজনের রাজনীতি কিছু অর্জন এনে দিতে পারে, তবে তা টেকসই নয়। স্থায়ী উন্নয়নের জন্য জাতীয় ঐক্যই আসল শক্তি।
উপসংহার
জাতীয় ঐক্য কেবল সুশাসনের পূর্বশর্ত নয়, বরং দেশের আত্মার প্রতিচ্ছবি। আজকের অস্থির বিশ্বে যেসব দেশ ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়েছে, তারা এগিয়ে গেছে। যারা বিভাজন ও প্রতিহিংসা বেছে নিয়েছে, তারা আজও সংকটে। এখন সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার—আমরা কোন পথে চলতে চাই?