ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-অলডাস হাক্সলি।

দূর ভবিষ্যতে, ২৫০৫ সালে, পৃথিবী অবশেষে এমন এক সমাজে পৌঁছেছে যাকে অনেকেই মানব সভ্যতার শিখর বলে মনে করে—শান্তি, স্থিতি এবং অনন্ত আনন্দ। যুদ্ধ বিলুপ্ত, রোগ-বালাই অদৃশ্য, আর প্রতিটি মানুষ তার নির্ধারিত স্থান, লক্ষ্য এবং হাসিমুখ নিয়ে পৃথিবীতে অবস্থান করছে।

কিন্তু এই সুচারুভাবে পরিচালিত সমাজের নিচে ছিল এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।


সেন্ট্রাল লন্ডন হ্যাচারি ও কন্ডিশনিং সেন্টারে সারি সারি টেস্ট টিউবে ভ্রূণ বড় হচ্ছিল। এখানে মানুষ জন্মায় না—তারা তৈরি হয়। হ্যাচারির পরিচালক শিক্ষানবীশদের একদলকে নিয়ে পুরো প্রক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। “আমরা বিকাশের প্রতিটি ধাপ নিয়ন্ত্রণ করি,” তিনি বলেন। “আমরা নির্ধারণ করি কতজন জন্মাবে, তারা কতটা বুদ্ধিমান হবে, শারীরিক গঠন কেমন হবে, এমনকি তারা কী ভালোবাসবে আর কী ঘৃণা করবে তাও।”

দলটি বোকানভস্কি প্রক্রিয়ার ঘরের সামনে থামে। একটি মানব ডিম ৯৬টি অভিন্ন ভ্রূণে বিভক্ত হচ্ছিল। “এটাই আমাদের সামাজিক স্থিতির বড় অস্ত্র,” পরিচালক গর্বের সঙ্গে বলেন।

মানুষদের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:

  • আলফা: বুদ্ধিমান ও শাসক শ্রেণি
  • বিটা: কিছুটা কম বুদ্ধিমান কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য
  • গামা, ডেল্টা ও এপসিলন: ক্রমাগত কম বুদ্ধিমান ও শ্রমিক শ্রেণি

প্রতিটি শ্রেণিকে ভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে গঠন করা হয় এবং ঘুমের মধ্যে শেখানো হয়—এই পদ্ধতির নাম হিপনোপিডিয়া। শৈশব থেকেই এপসিলনদের শেখানো হয় যে তারা পড়াশোনা ঘৃণা করে, এবং কারখানায় কাজ করতে ভালোবাসে। আলফারা শেখে তারা জন্মেছে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ব্যক্তিত্বের কোনো মূল্য নেই; একমাত্র স্থিতিই সবার কাম্য।


লেনিনা ক্রাউন, এক বিটা প্রযুক্তিবিদ, তার সৌন্দর্য ও অনুগত্যের জন্য পরিচিত। সে হেনরি ফস্টারের সঙ্গে সম্পর্কে ছিল, তবে এবার সিদ্ধান্ত নেয় নতুন কাউকে চেনার—বার্নার্ড মার্কসকে।

বার্নার্ড আলফা প্লাস হলেও শারীরিকভাবে ছোট হওয়ায় নিজেকে নিয়ে অনিশ্চিত। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সমস্যা—সে প্রশ্ন করে। সে সোসাইটির আনন্দনির্ভর পদ্ধতিতে অস্বস্তি বোধ করে। সে গভীর কিছু খোঁজে, নিঃসঙ্গতা চায়, এবং অর্থপূর্ণ জীবনের আকাঙ্ক্ষা করে।

লেনিনা দ্বিধা সত্ত্বেও রাজি হয় বার্নার্ডের সঙ্গে নিউ মেক্সিকোর স্যাভেজ রিজারভেশন ঘুরতে যাওয়ার জন্য। এই এলাকা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেখানে মানুষ পরিবারে বসবাস করে, ধর্ম পালন করে এবং রোগ, বার্ধক্য ও দুঃখভোগ করে।

সেখানে তারা জন নামে এক তরুণকে পায়, যে লিন্ডা নামের এক বিটা মায়ের সন্তান। লিন্ডা এক সময় দুর্ঘটনাবশত রিজারভেশনে আটকা পড়ে এবং জনকে জন্ম দেন। শেক্সপিয়ারের একটি পুরনো বই থেকে জন শিখেছিল ভালোবাসা, সম্মান আর আত্মত্যাগের ভাষা। তবে তার পরিচয় ছিল দ্বৈত—সে ছিল না পুরোপুরি স্যাভেজ, না পুরোপুরি সভ্য।

বার্নার্ড জন এবং লিন্ডাকে লন্ডনে ফিরিয়ে আনে।


লন্ডনে ফিরে জন এক অদ্ভুত আকর্ষণ হয়ে ওঠে। “স্যাভেজ” জনকে সবাই দেখতে চায়। তার অদ্ভুত ভাষা, আবেগপ্রবণতা, ভালোবাসার ধারণা সবাইকে মুগ্ধ করে। কিন্তু জন এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়।

সে দেখে সবাই সোমা নামের ড্রাগ খেয়ে দুঃখ এড়ায়। সম্পর্কগুলো যেন খেলাধুলা, ভালোবাসার কোনো স্থান নেই। শিশুরা শিখছে মৃত্যুতে হাসতে। তার মা সোমা সেবনে অচেতন হয়ে পড়ে।

জন গভীর বেদনা নিয়ে শেক্সপিয়ারের শরণ নেয়। যখন লেনিনা তাকে যৌন মিলনের জন্য আকর্ষন করে, সে রাগে-দুঃখে তাকে ‘বেশ্যা’ বলে। সে কেবল যৌন মিলন চায় না তার সাথে চায় প্রেম চায়, সংযোগ চায়, সত্যিকারের কিছু। লেনিনা তার কিছুই বোঝে না।

জন একসময় সোমা বিতরণ কেন্দ্রে আক্রমণ চালায়। “এটা খেয়ো না! নিজেকে মুক্ত করো! দুঃখ অনুভব করো, আনন্দ অনুভব করো!”

লোকজন হাসে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।


বার্নার্ড, হেলমহোল্টজ (অন্য এক বিদ্রোহী আলফা), ও জনকে নেওয়া হয় বিশ্ব নিয়ন্ত্রক মুস্তাফা মন্ড-এর কাছে। তিনি নিষ্ঠুর নন—বরং যুক্তিবাদী, শান্ত। তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন সমাজ এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে।

“আমরা শিল্প ও সত্য বিসর্জন দিয়েছি সামাজিক স্থিতির জন্য,” তিনি বলেন। “মানুষকে দুঃখহীন করতে আমরা তাদের অনুভূতি দমন করেছি।”

তিনি নিষিদ্ধ বই দেখান—বাইবেল, প্লেটো, শেক্সপিয়ার। তিনি স্বীকার করেন, তিনিও একসময় প্রশ্ন করতেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ বেছে নিয়েছেন।

জন জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু স্বাধীনতা কি দুঃখ সহ্য করার মতো নয়?”

মন্ড বলেন, “তুমি দুঃখিত হওয়ার অধিকার চাইছ।”

জন উত্তর দেয়, “আমি সব অধিকার দাবি করি।”

বার্নার্ডকে নির্বাসিত করা হয়। হেলমহোল্টজ খুশি মনেই যায়। কিন্তু জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।


জন একটি পরিত্যক্ত লাইটহাউসে আশ্রয় নেয়। সে পবিত্রতা খোঁজে উপবাস, নিঃসঙ্গতা ও আত্মদণ্ডে। কিন্তু সে রক্ষা পায় না। লোকজন তাকে খুঁজে পায়। ক্যামেরা আসে। লেনিনা আবার আসে।

দুশ্চিন্তা ও বিকারগ্রস্ত মুহূর্তে জন তাকে আক্রমণ করে। পরদিন, অপরাধবোধে ভেঙে পড়ে, এবং আত্মহত্যা করে।


ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড শেষ হয় কোনো বিদ্রোহ দিয়ে নয়—বরং নীরবতায়। একটি সমাজ যা আনন্দ ও নিয়ন্ত্রণে গঠিত, সে সমাজ তার একমাত্র বিদ্রোহীকেও দমন করে, অস্ত্র দিয়ে নয়—অর্থহীনতার মধ্য দিয়ে।

বিশ্ব রয়ে যায় স্থির, শান্ত, সুখী।

এবং পুরোপুরি মানবতাহীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *