একটি রাষ্ট্রকে টিকে রাখে কী? সামরিক ক্ষমতা, বিপুল বাজেট, নাকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চকচকে সংখ্যা?—না, এগুলো কোনো রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার ভিত্তি নয়। রাষ্ট্র টিকে থাকে তখনই, যখন জনগণ মনে করে—“এই দেশ আমার।” সেই অনুভবের নামই আস্থা।
রাষ্ট্র হলো জীবন্ত এক সংগঠন, যার প্রাণশক্তি নাগরিকের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাবোধে নিহিত। যে দেশে মানুষ ভয়ে কথা বলতে পারে না, সেখানে আইন, উন্নয়ন বা প্রশাসন সবই ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, ভয় থেকে যে নীরবতা জন্ম নেয়, তা এক সময় রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকেই স্তব্ধ করে দেয়।
ইতিহাস সাক্ষী—যে শাসক জনগণকে ভয় দেখিয়ে শান্ত রাখতে চেয়েছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেই ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ভয় যত গভীর হয়, প্রতিবাদের আগুনও ততই ভেতরে জ্বলতে থাকে। ফরাসি রাজতন্ত্র, রোমান সাম্রাজ্য কিংবা আধুনিক যুগের স্বৈরশাসন—সবখানেই সেই একই পরিণতি দেখা গেছে: ভয় দিয়ে রাষ্ট্র টেকে না।
একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি অর্থনীতির আকারে নয়, জনগণের মুখের হাসিতে মাপা যায়। নাগরিক যদি নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে না পারে, মুক্তভাবে কথা বলতে না পারে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অগ্রগতি যতই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করা হোক না কেন—তা ভিতর থেকে ফাঁপা হয়ে থাকে।
রাষ্ট্র কোনো শাসকের সম্পত্তি নয়; এটি জনগণের যৌথ উদ্যোগ। যারা এই সাধারণ সত্যটি ভুলে যায়, তারা আসলে রাষ্ট্রের ভেতরেই বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে। কারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যায়, কিন্তু সেই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা যায় না।
বিশ্বজুড়ে সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এক সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—জনগণের স্বাধীনতা যত পূর্ণ, রাষ্ট্র তত শক্তিশালী। যেখানে নাগরিকের মুখে তালা, সেখানে উন্নয়নের স্লোগানও নিঃশব্দে মরে যায়।
সুতরাং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার আসল মাপকাঠি হলো—মানুষের মুক্তভাবে বাঁচার অধিকার, ভয়হীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং ন্যায়বিচারে আস্থা। এ তিনটি শর্ত পূরণ হলেই রাষ্ট্র জীবন্ত থাকে; অন্যথায়, তা কেবল একটি প্রশাসনিক যন্ত্রে পরিণত হয়—চলে, কিন্তু বাঁচে না।
যেদিন রাষ্ট্র নাগরিককে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেয়, সেদিনই তার মেরুদণ্ড সোজা হয়। তাই রাষ্ট্রের টিকে থাকার চিরন্তন সূত্র একটাই:
“জনগণের স্বাধীনতা যত বেশি, রাষ্ট্র তত স্থিতিশীল।”