আধুনিক বিশ্বে ব্যক্তি স্বার্থ অনেক সময় সমাজের কল্যাণের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। নিজের সুবিধার কথা ভাবা স্বাভাবিক, তবে যখন সেটি সীমাহীন স্বার্থপরতায় পরিণত হয়, তখন তা উল্টো ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কল্পনা করুন, একটি দেশে প্রতিটি মানুষ যদি শুধুমাত্র নিজের সুবিধা নিয়েই ভাবতে শুরু করে—অন্যের প্রয়োজন, অধিকার কিংবা নিরাপত্তা উপেক্ষা করে—তাহলে সেই সমাজ আর দীর্ঘদিন টিকবে না। কারণ মানুষ একটি সামাজিক প্রাণী। আর সমাজে বসবাস করতে হলে প্রত্যেককেই কিছুটা করে নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়, যাতে সকলেরই সম্মিলিত লাভ নিশ্চিত হয়—এবং সেটির মধ্যে নিজের লাভও অন্তর্ভুক্ত।
মানব প্রকৃতি: সামাজিক প্রাণীর অস্তিত্ব
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই আমাদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন হয়েছে সহযোগিতা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সহায়তার। প্রাচীনকালে মানুষ একত্রে শিকার করত, একে অপরের নিরাপত্তা রক্ষা করত, খাবার ভাগ করে খেত। এই গুণগুলোর কারণেই মানবজাতি প্রকৃতির প্রতিকূলতা ও বিপদ মোকাবিলা করে আজ পর্যন্ত টিকে আছে। আধুনিক সমাজেও এই ভিত্তি অপরিবর্তিত। আমরা যে খাবার খাই, যে রাস্তা দিয়ে চলি, যে নিরাপত্তা উপভোগ করি—সবকিছুই গঠিত হয় সম্মিলিত সামাজিক চেষ্টার মাধ্যমে। যদি সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি কেবল নিজের স্বার্থ দেখে চলত, তবে সমাজের কোন প্রতিষ্ঠানই কার্যকর থাকত না এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
সর্বজনীন স্বার্থপরতার পরিণতি
ধরা যাক, একটি রাস্তায় প্রতিটি চালক নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে এতটাই ব্যস্ত যে ট্রাফিক সিগনাল মানে না, কাউকে রাস্তা দেয় না—তাহলে কী হবে? সড়কে নেমে আসবে বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা, এবং অবরোধ। অবশেষে সেই স্বার্থপর চালকও ভোগান্তির শিকার হবেন।nএটি হচ্ছে “ট্রাজেডি অব দ্য কমন্স”-এর একটি বাস্তব রূপ। যেখানে সবাই নিজের সর্বোচ্চ লাভের পেছনে ছোটে, সেখানে শেষ পর্যন্ত সবারই ক্ষতি হয়। পরিবেশ দূষণ, দুর্নীতি, খাদ্য মজুত, তথ্য বিকৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এই বাস্তবতা প্রযোজ্য।
পারস্পরিক ত্যাগ মানেই সম্মিলিত অর্জন
এটাই স্বার্থের বিপরীত যুক্তি—যখন সবাই কিছুটা করে ত্যাগ করে, তখন প্রত্যেকেই আরও বেশি লাভবান হয়। কেউ যখন বিপদে থাকা অপরকে সাহায্য করে, তখন সে সমাজে সহানুভূতির বাতাবরণ তৈরি করে। কেউ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন সে নিজেকেই একটি ন্যায্য সমাজে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়া, মহামারির মোকাবিলায় সম্মিলিত চেষ্টাসহ ইতিহাসে এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে ব্যক্তিগত ত্যাগ এনে দিয়েছে সামাজিক বিজয়।
উপসংহার: উন্নত সমাজ গড়ার শুরু হয় ব্যক্তি থেকে
সবশেষে বলা যায়, নিজের স্বার্থ দেখা দোষের নয়, তবে যদি সবাই শুধু নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে কারো স্বার্থই সুরক্ষিত থাকে না। একটি সমাজে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেককেই সামান্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, যাতে সেই সমাজে সবাই—এমনকি সেই ব্যক্তি নিজেও—লাভবান হতে পারে। সত্যিকার শক্তি আসে তখনই, যখন আমরা কেবল নিজেদের নয়, অন্যদের কল্যাণের প্রতিও সচেতন থাকি। একটি সমাজ যেখানে সবাই সামান্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত, সেটাই হয় সবথেকে লাভবান, টেকসই ও সুন্দর সমাজ।