সারসংক্ষেপ
২০২৪ সালে গঠিত এবং ২০২৫ সালে প্রতিবেদন প্রকাশকারী বাংলাদেশ প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের (BARC) উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক করে গড়ে তুলতে নাগরিক-কেন্দ্রিক সংস্কারের সুপারিশ প্রদান। বিস্তৃত গবেষণা ও অংশীজন পরামর্শের মাধ্যমে প্রণীত এই প্রতিবেদন সরকারি খাতের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মূল কারণসমূহ চিহ্নিত করে এবং শাসন, জনসেবা, বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগীয় সমন্বয়, স্বচ্ছতা, ডিজিটাল রূপান্তর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার জন্য কাঠামোবদ্ধ সুপারিশ প্রদান করে।
ভবিষ্যত দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- ভিশন: জনগণকেন্দ্রিক সেবার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা।
- মূল মূল্যবোধ: স্বচ্ছতা, মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা, অন্তর্ভুক্তি, নিরপেক্ষতা, দ্রুত সাড়া প্রদান।
- লক্ষ্যসমূহ: রাষ্ট্রীয় দক্ষতা ও গণবিশ্বাস বৃদ্ধি, পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা, সেবার মানোন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা সুসংহত করা।
মূল কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জসমূহ
- প্রশাসনিক ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ
- কর্তৃত্ব হস্তান্তরের সুস্পষ্ট নীতির অভাব
- প্রশাসনের সর্বস্তরে রাজনৈতিক প্রভাব
- মন্ত্রণালয়সমূহ ও কেন্দ্র-স্থানীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি
- জবাবদিহিতার দুর্বল কাঠামো
- নাগরিক সম্পৃক্ততার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই
প্রধান সুপারিশসমূহ (বিষয়ভিত্তিক)
১. প্রশাসনিক আধুনিকায়ন
- ডিজিটাল রূপান্তর ও পরিবর্তন ব্যবস্থাপনার কাঠামো প্রণয়ন
- মন্ত্রণালয়সমূহে তথ্য প্ল্যাটফর্মের আন্তঃসংযোগ নিশ্চিতকরণ
- প্রধান কর্মসম্পাদন ক্ষেত্র (KPA) নির্ধারণ ও ড্যাশবোর্ড চালু
- সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনগত ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা
২. সিভিল সার্ভিস সংস্কার
- সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধি হালনাগাদ করে নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ
- স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও সম্পদ ঘোষণা বাধ্যতামূলক করা
- মেধা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে পদোন্নতি এবং প্রশিক্ষণ চালু
- নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক প্রভাব নির্মূল
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
- তথ্য অধিকার আইন (RTI) বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা
- জাতীয় মূল্যায়ন ও সামাজিক জরিপ (NESS) চালু করা
- মোবাইল অ্যাপ ও নাগরিক পোর্টালের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ ও সেবা পর্যবেক্ষণ
- প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে গণশুনানি ও বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক
৪. বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার
- আর্থিক, প্রশাসনিক ও কার্যকর ক্ষমতা দিয়ে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করা
- সেবা-ভিত্তিক লোকাল গভর্নমেন্ট ক্যাডার গঠন
- স্থানীয় সরকারে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও বাজেট স্বায়ত্তশাসন
- অংশগ্রহণমূলক বাজেট পরিকল্পনার পাইলট বাস্তবায়ন
৫. দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা
- সুরক্ষিত তথ্যদাতাদের (Whistleblower) আইন কার্যকর করা
- সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ যাচাই বাধ্যতামূলক
- দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
- সকল মন্ত্রণালয়ে ই-প্রকিউরমেন্ট চালু করা
৬. নাগরিক সম্পৃক্ততা
- সামাজিক নিরীক্ষা ও অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া
- বাজেট পরিকল্পনা ও পরিবীক্ষণে জনগণের অংশগ্রহণ
- সংস্কার কমিটিগুলোতে নারী, সংখ্যালঘু ও নাগরিক সমাজের অন্তর্ভুক্তি
৭. বিচার বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়
- প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় জোরদার
- প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সেবাসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা
- গোপনীয়তা আইনের সংস্কার করে স্বচ্ছতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা
৮. লিঙ্গ ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি
- লিঙ্গ সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন
- জাতীয় ও স্থানীয় প্রশাসনে নারীর নেতৃত্বে উৎসাহ
- সেবায় ও কমিটিতে কোটা নির্ধারণ
- অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরীক্ষা চালু করা
৯. মনিটরিং ও মূল্যায়ন
- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে একটি স্বাধীন মূল্যায়ন শাখা গঠন
- KPAs ও রিয়েল-টাইম তথ্য ব্যবহার করে মন্ত্রণালয়ের কার্যকারিতা পর্যালোচনা
- গণবিশ্বাস ও জনমত জরিপ পরিচালনা
- সংসদীয় নজরদারির জন্য বার্ষিক অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ
বাস্তবায়ন কৌশল
- প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সংস্কার সংক্রান্ত ফোকাল পয়েন্ট নিয়োগ
- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি বাস্তবায়ন তদারকি সেল (IMC) গঠন
- বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব
- জাতীয় বাজেট ও পরিকল্পনার সঙ্গে সংস্কারের সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করা
আইনি ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা
- নতুন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যাক্ট খসড়া প্রণয়ন
- মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- একাধিক একই ধরনের দপ্তর পুনর্গঠন এবং প্রতিবেদন কাঠামো সরলীকরণ
- তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে মিল রেখে গোপনীয়তা আইন সংশোধন
উপসংহার
২০২৫ সালের এই BARC প্রতিবেদন বাংলাদেশে একটি পেশাদার, নৈতিক ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের ভবিষ্যতমুখী রোডম্যাপ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তথ্যনির্ভর শাসনের ভিত্তিতে নির্মিত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছা, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের টেকসই সহযোগিতা। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসবে এবং ভিশন ২০৪১ অর্জনের পথে এক বড় অগ্রগতি হবে।
পরিশিষ্ট: ২০২৫-২০২৮ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহ
- ২০২৮ সালের মধ্যে নাগরিক সেবা সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালাইজেশন
- শতভাগ মন্ত্রণালয় বার্ষিক কর্মসম্পাদন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ
- সব মন্ত্রণালয়ে নাগরিক সনদ ও নৈতিকতা প্রশিক্ষণ চালু
- দেশব্যাপী ই-প্রকিউরমেন্ট কার্যকর
- জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের ৪০% স্থানীয় সরকারকে প্রদান
- ৯০% সরকারি দপ্তরে তথ্য অধিকার আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন
- ২০২৭ সালের মধ্যে প্রশাসনে লিঙ্গ সমতা অর্জন
- ২০২৬ সালের মধ্যে জাতীয় সংস্কার পর্যবেক্ষণ ড্যাশবোর্ড চালু