বাংলাদেশে রমজান মাস এলেই সাধারণত নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে—এমন একটি ধারণা বহুদিনের। কিন্তু ২০২৫ সালের রমজান ছিল ব্যতিক্রম। খোদ একটি জাতীয় পত্রিকার জরিপ বলছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ রমজানের বাজার পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। তাহলে এবার এমন ইতিবাচক চিত্রের পেছনে কী কাজ করেছে?
মূল্য কমেছে, সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত
রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে—যেমন খেজুর, ছোলা, ডাল, চিনি, ডিম, চাল, ফল, সবজি, মাছ-মাংস—তাঁর বেশির ভাগই এবার আগের বছরের তুলনায় সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া গেছে।
- খেজুরের দাম ৩০–৫০% কমেছে।
- ডিম ১২০ টাকা ডজন, আগে যা ছিল ১৯০ টাকা।
- ছোলা ও ডাল ৫ থেকে ৩৫% কমে বিক্রি হয়েছে।
- আলু, টমেটো ও অন্যান্য সবজির দামও কম ছিল।
- চিনির দামও প্রতি কেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
ভোজ্যতেলে সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ
রমজানের শুরুতে কিছুটা সমস্যা থাকলেও পরে ভোজ্যতেল বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।
- আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও সরকার তিনটি বড় পদক্ষেপ নেয়:
১. শুল্ক–কর কমানো (১৫% থেকে ৫%)
২. মূল্য সমন্বয় করে নির্ধারিত দাম নির্ধারণ
৩. বিকল্প তেলের উৎস বৃদ্ধি, যেমন—ক্যানোলা, সানফ্লাওয়ার এবং রাইস ব্র্যান তেল।
রাইস ব্র্যান তেল আমদানি ও ব্যবহারে নতুন দিগন্ত খুলেছে। এতে যেমন স্থানীয় উৎপাদন যুক্ত হয়েছে, তেমনি তিন হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে।
চালের ঘাটতি মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ
বন্যার কারণে আমনের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চালের কিছুটা ঘাটতি হয়। কিন্তু সরকার দ্রুত আমদানির অনুমতি দিয়ে শুল্ক কমিয়ে ৬৩% থেকে ৩%-এ আনে।
ফলে দেশি বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাশাপাশি আটা ও ময়দার দাম কম থাকায় মানুষ বিকল্প খাদ্য বেছে নিতে পেরেছে।
ভোক্তাদের সংযত আচরণ বাজারে ভারসাম্য এনেছে
এবার ভোক্তাদের আচরণে গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন দেখা গেছে—
‘প্যানিক বায়িং’ বা আতঙ্কে অতিরিক্ত কেনাকাটা তেমন দেখা যায়নি।
- যেমন, শুরুতে লেবুর দাম হালি ১০০ টাকা থাকলেও মানুষ অতিরিক্ত কেনেনি, পরে দাম ৩০–৪০ টাকায় নেমে আসে।
সরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে সুফল
বাজার ব্যবস্থাপনায় সফলতার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ।
- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআরসহ সবাই একসঙ্গে পরিকল্পনা করে আগেভাগে প্রস্তুতি নেয়।
- প্রতিটি পণ্যের বাজার বিশ্লেষণ করে সময়োপযোগী সুপারিশ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
নতুন আমদানিকারকের আগমন বাজারে এনেছে গতিশীলতা
এবার আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে ৩৬৫ থেকে ৪৯৯-এ।
- আমদানির পরিমাণ ও মূল্য দুই-ই বেড়েছে যথাক্রমে ৩৪% ও ৫১%।
- সরকারের আগাম প্রস্তুতি ও শুল্ক–কর হ্রাসের কারণেই নতুন ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পেয়েছে।
সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির দমন বাজারে স্বস্তি এনেছে
বাজারে চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত মজুতদারির অভিযোগ এবার অনেকটাই কম ছিল।
- রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে এসব চক্র কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
- মাঠপর্যায়ের জরিপে এসব তথ্যও উঠে এসেছে, যার ফলে অতিরিক্ত খরচ কমে গেছে এবং পণ্য সরবরাহ সহজ হয়েছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
রমজানে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা ভবিষ্যতেও ধরে রাখতে হবে।
- বাজারে মৌসুমি চাহিদা অনুযায়ী মজুত বাড়াতে হবে।
- বন্দরে পণ্য খালাসে বিলম্ব ঠেকাতে হবে।
- মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালান ঠেকাতে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
- ‘ট্যারিফ পলিসি ২০২৩’ সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা জরুরি।