অপরিকল্পিত ভ্যাট ও ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি একশটিরও বেশি পণ্যে কর বৃদ্ধির ফলে জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চমূল্যের এই চাপ এমন সময়ে এসেছে, যখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ এবং মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে এই কর বৃদ্ধির ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর বিকল্প
সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায্য চাপ সৃষ্টি করছে। সম্পদশালী ব্যক্তি ও কর্পোরেশনরা বিভিন্ন কর সুবিধা এবং ট্যাক্স ফাঁকির সুযোগ নিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। এর ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে সম্পদশালীদের ওপর কর আদায়ের ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং পরোক্ষ কর কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
ব্যবসা ও ভোক্তাদের ওপর প্রভাব
উচ্চ করনীতি শুধুমাত্র ভোক্তাদের ওপর নয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবার কর বৃদ্ধি তাদের কার্যক্রমের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, কর হার কমালে ভোক্তা ব্যয় বাড়ে, যা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে, স্থিতিস্থাপক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট দ্বিগুণ করলে চাহিদা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা রাজস্ব লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আইএমএফের চাপ এবং কর বাড়ানোর উদ্দেশ্য
এই কর বৃদ্ধি মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের ফল। আইএমএফ ২০২৫–২৬ অর্থবছরের মধ্যে ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্তে $৪.৭ বিলিয়ন ঋণ দিয়েছে। এই শর্ত অনুযায়ী সরকারের আরও ১২,০০০ কোটি টাকার কর আদায় করতে হবে। কিন্তু হঠাৎ করে কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি
সরকারের এই করনীতির কারণে সামাজিক বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী ভ্যাট বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাবের শিকার হলেও সম্পদশালী ব্যক্তিরা কর ফাঁকি ও কর ছাড়ের সুবিধা পাচ্ছে। ভারতের মতো দেশগুলোর মতো প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে একটি ন্যায়সংগত কর কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
উন্মুক্ত বাজার বিক্রয় কর্মসূচি বন্ধের প্রভাব
ট্রেডিং কর্পোরেশনের উন্মুক্ত বাজারে পণ্য বিক্রয় কর্মসূচি স্থগিত হওয়ায় দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই কর্মসূচি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা ছিল। এমন একটি উদ্যোগ বন্ধ হওয়া সরকারের বাস্তব নীতির সঙ্গে disconnect-এর একটি উদাহরণ।
কর ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের কর-টু-জিডিপি অনুপাত এ অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি একটি বড় সমস্যা নির্দেশ করে এবং কর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। সম্ভাব্য করদাতাদের ৬৮ শতাংশই আয়কর প্রদান করেন না। কর ফাঁকি বন্ধ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর ব্যবস্থাকে উন্নত করা গেলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পাবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর করের চাপ কমানো সম্ভব হবে।
উপসংহার
সরকারের বর্তমান করনীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলছে। রাজস্ব নীতিতে সংস্কার এনে, প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি গঠন সম্ভব। দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এই কর বৃদ্ধি নীতিগত ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেবে, যার ফলশ্রুতিতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।