প্রতিবাদ—এই শব্দটি শুনলেই অনেকের মনে ভেসে ওঠে রাস্তায় মানুষ, শ্লোগানে মুখরিত জনতা, কিংবা পুলিশের টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া। কিন্তু ২১ শতকের সমাজে প্রতিবাদের ধরন পাল্টে গেছে, পাল্টেছে এর ভাষা ও উপস্থাপন। এখন প্রতিবাদ মানেই কেবল সড়কে নামা নয়—এটা হতে পারে একখণ্ড চিত্র, একটি কবিতা, একটি ছোট্ট নাট্যাংশ, বা এমনকি একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টও। তবে প্রতিবাদের ধরন যেমনই হোক না কেন, কিছু মৌলিক নীতির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি থাকা চাই। প্রতিবাদ যেন হয় মানবিক, যুক্তিনির্ভর, এবং সর্বোপরি, জনসচেতনতা বৃদ্ধির একটি ইতিবাচক মাধ্যম। এই ধরনের প্রতিবাদ কাউকে অপমান বা আঘাত না করে, বরং সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়, চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করে।
ধরা যাক, শহরের ব্যস্ত মোড়ে কিছু তরুণ শিল্পী হঠাৎ করেই পলিথিনে ঢাকা একটি গাছের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কেউ কিছু বলছেন না, কারো হাতে কোনো প্ল্যাকার্ড নেই। শুধু পলিথিনে মোড়া গাছটিকে ঘিরে একটি নীরবতা। পথচারীরা থেমে গেল, ছবি তুলল, প্রশ্ন করল—এটি কী হচ্ছে? শিল্পীরা তখন জানান, এটি এক ধরনের পরিবেশ সচেতনতা আন্দোলন, যেখানে তারা বোঝাতে চেয়েছেন কিভাবে প্লাস্টিক আমাদের জীবনের প্রাণপ্রকৃতিকে দমিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতিবাদে নেই কোনো হিংসা, নেই কোনো কটু বাক্য। কিন্তু আছে গভীর বার্তা, আছে সমাজকে জাগিয়ে তোলার এক অভিনব ভাষা।
আবার দেখা যাক অন্য একটি উদাহরণ। গ্রামে পানীয় জলের অভাব নিয়ে যখন বারবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও কেউ গুরুত্ব দিচ্ছিল না, তখন গ্রামের কিশোরীরা একটি নাটক মঞ্চস্থ করলো বাজারের মাঝে। সেখানে দেখানো হলো কীভাবে একটি শিশুর জীবন জলবাহিত রোগে ঝুঁকির মুখে পড়ছে। নাটক শেষ হতেই দর্শকদের চোখে জল। অনেকেই সেই মুহূর্তেই স্থানীয় প্রশাসনে অভিযোগ জানাতে আগ্রহী হন। এই ঘটনা আবার প্রমাণ করে, প্রতিবাদ মানেই কেবল ক্ষোভ নয়—এটি হতে পারে আবেগ, করুণা ও যুক্তির মিলিত রূপ।
আমরা যখন সমাজ পরিবর্তনের কথা বলি, তখন ভুলে যাই—বড় পরিবর্তন আসে ছোট ছোট প্রতিবাদে। অনেকেই ভাবেন, প্রতিবাদ মানেই শাসকের বিরুদ্ধে রোষ প্রকাশ। কিন্তু প্রকৃত প্রতিবাদ হলো এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আহ্বান—যা মানুষকে ভাবায়, প্রশ্ন তোলে, এবং নতুন চিন্তার দ্বার খুলে দেয়।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে সোশ্যাল মিডিয়া একটি নতুন প্রতিবাদমাধ্যমে রূপ নিয়েছে। কেউ একটি সচেতনতামূলক ভিডিও বানাচ্ছে—যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট তুলে ধরা হচ্ছে; কেউ লিখছে একটি কবিতা, যেখানে ফুটে উঠছে শহরের ধূলিঝড়ে ঢাকা মানুষের নিঃশব্দ কান্না। এসব প্রতিবাদে নেই চিৎকার, নেই কোনো স্লোগান, তবুও এসব গভীরতর। কারণ এগুলো হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে, বিবেককে নাড়া দেয়। একটি উন্নত সমাজ গড়তে গেলে এমন সৃজনশীল প্রতিবাদের চর্চা জরুরি। কারণ কেবল রাজপথ দখল করলেই পরিবর্তন আসে না—পরিবর্তনের জন্য দরকার চিন্তার বিপ্লব। আর সেই বিপ্লব শুরু হয় এমন এক প্রতিবাদ থেকে, যা যুক্তি ও আবেগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
এজন্য, আমাদের প্রতিবাদ হোক নতুন দৃষ্টিকোণের সন্ধান। আমাদের ভাষা হোক সৃজনশীল, আমাদের বার্তা হোক মননে জাগরণমুখী, এবং উদ্দেশ্য হোক সমাজের কল্যাণ। প্রতিবাদ যেন শুধু মুহূর্তের ক্ষোভে নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী চেতনার ফল হিসেবে আবির্ভূত হয়।কখনো প্রতিবাদ হবে একটি বইয়ের রচনার মাধ্যমে—যেমন একটি তরুণ লেখক লিখে ফেললেন ‘কেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ’, যেখানে তিনি প্রথাগত শিক্ষার অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরেন পরিসংখ্যান, অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে। কখনো সেটা হবে চলচ্চিত্রে—যেমন একদল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা বানিয়ে ফেললেন ‘আধঘণ্টার জীবন’, যেখানে ফুটে উঠল গৃহকর্মীর জীবনের লাঞ্ছনা। এইসবই প্রতিবাদ। কিন্তু এগুলোতে নেই ধ্বংস, আছে নির্মাণের আশ্বাস।
অতএব, প্রতিবাদ যেন হয়ে ওঠে আলোর বাহক। আমাদের প্রতিবাদে থাকুক শ্রদ্ধা, যুক্তি, এবং সত্যনিষ্ঠতা। আমরা চাই এমন এক প্রতিবাদ, যা কেবল ক্ষমতার বিরুদ্ধে নয়, বরং সমাজের অনুশাসনের মধ্যেও মানবতার আলোকবর্তিকা জ্বালাতে সক্ষম। কারণ, কেবল বিবেকনির্ভর, নির্মল ও সৃজনশীল প্রতিবাদই পারে সমাজকে বদলাতে, মানুষকে জাগাতে এবং অন্ধকার ঠেলে নতুন ভোর আনতে।