ভূমিকা
পপুলিজম বা জনতাবাদ এমন এক রাজনৈতিক কৌশল, যেখানে নেতা জনগণের আবেগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অসন্তোষকে সরাসরি স্পর্শ করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন এবং নিজেকে “জনগণের কণ্ঠস্বর” হিসেবে উপস্থাপন করেন। এতে অনেক সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শোনা যায় বটে, তবে জটিল নীতি-সংক্রান্ত সমস্যাকে সরল স্লোগানে রূপ দেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি শাসন ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অবহেলিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পপুলিজম বহুদিন ধরেই একটি প্রধান চালিকা শক্তি।
পপুলিজমের বৈশিষ্ট্য
বিশ্বব্যাপী পপুলিজম “আমরা বনাম তারা” কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে—যেখানে “আমরা” বলতে সাধারণ জনগণকে এবং “তারা” বলতে ক্ষমতাবান ও দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত শ্রেণিকে বোঝানো হয়। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, কিংবা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ব্যবহার করে জনমত সংগঠিত করা হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগত ও নীতিগত সংস্কার অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়।
বাংলাদেশে এই প্রবণতা দেখা যায় যখন নেতারা নিজেদেরকে জাতির ত্রাণকর্তা, ধর্মের রক্ষক বা গরিবের বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করেন, প্রায়ই এমন আবেগময় ভাষা ব্যবহার করে যা জনগণকে বিভক্ত করে ফেলে।
বাংলাদেশে পপুলিজম: ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পপুলিস্ট ধারা প্রবলভাবে বিদ্যমান। মতাদর্শ যাই হোক না কেন, প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল ভোট পাওয়ার জন্য পপুলিস্ট স্লোগান ব্যবহার করেছে।
- উন্নয়নমূলক পপুলিজম – বড় অবকাঠামো প্রকল্প, ভর্তুকি ও কল্যাণমূলক কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু টেকসই পরিকল্পনার অভাব থাকে।
- জাতীয়তাবাদী পপুলিজম – একটি দলকে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বা জাতীয় পরিচয়ের একমাত্র রক্ষক হিসেবে দেখানো হয় এবং বিরোধীদের এসবের জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
- ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পপুলিজম – ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়, যাতে “আমরা” বনাম “ওরা” পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি—বারবার ক্ষমতায় এসেছে মূলত এ ধরনের জনতাবাদী কৌশলের মাধ্যমে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগত সংস্কারের চেয়ে রাজনৈতিক আধিপত্যই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
বাংলাদেশে পপুলিজমের প্রভাব
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হওয়া – আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নির্বাহী ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে।
- স্বল্পমেয়াদি নীতি অগ্রাধিকার – দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বদলে দ্রুত দৃশ্যমান প্রকল্পে মনোযোগ দেওয়া হয়।
- রাজনৈতিক মেরুকরণ বৃদ্ধি – জনতাবাদী ভাষণ সমাজ ও রাজনীতিকে আরও বিভক্ত করে, ফলে ঐকমত্যভিত্তিক নীতি প্রণয়ন কঠিন হয়।
- নীতির গুণগত মানের অবনতি – প্রমাণভিত্তিক আলোচনার পরিবর্তে আবেগনির্ভর স্লোগান প্রাধান্য পায়, যা সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে পপুলিজমের প্রসারের কারণ
- রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব – নাগরিক শিক্ষার ঘাটতির কারণে ভোটাররা প্রায়ই আবেগী আহ্বানে সাড়া দেন, নীতি বিশ্লেষণ নয়।
- দুর্বল প্রতিষ্ঠান – দলগুলো ব্যক্তি-নির্ভর, ফলে নেতা সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন।
- দারিদ্র্য ও বৈষম্য – দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাৎক্ষণিক স্বস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।
- ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি – স্বৈরশাসন ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনার রাজনীতি নেতাকেন্দ্রিক ধারাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে।
পপুলিজমের নেতিবাচক প্রভাব কমানোর করণীয়
- নাগরিক শিক্ষা জোরদার করা
- স্কুল ও কমিউনিটি পর্যায়ে অরাজনৈতিক নাগরিক শিক্ষা চালু করা।
- গণসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বোঝানো।
- প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
- নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা যাতে বিভাজনমূলক ও উসকানিমূলক প্রচার বন্ধ করা যায়।
- সংসদীয় কমিটিগুলোর ক্ষমতা বাড়িয়ে সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ জোরদার করা।
- গণমাধ্যমের ভূমিকা
- ফ্যাক্ট-চেকিং উদ্যোগ উৎসাহিত করা ও ইচ্ছাকৃত ভ্রান্ত তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
- ব্যক্তিকেন্দ্রিক খবরের পরিবর্তে নীতি-ভিত্তিক আলোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া।
- দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
- দলের অভ্যন্তরে স্বচ্ছ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করা।
- বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের বদলে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন।
- অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রণয়ন
- নীতি প্রণয়নে সুশীল সমাজ, একাডেমিক মহল ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করা।
উপসংহার
বাংলাদেশে পপুলিজম রাজনৈতিক সমস্যার কারণও বটে, আবার এর ফলও বটে। এটি জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় করলেও নিয়ন্ত্রণহীন পপুলিজম প্রায়ই প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, নীতির মানহানি ও বিভাজন বৃদ্ধি করে। এর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে প্রয়োজন নীতি-ভিত্তিক রাজনীতি, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সচেতন নাগরিক সমাজ। কেবল তবেই বাংলাদেশ আবেগ-নির্ভর, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে সরে এসে দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার পথে এগোতে পারবে।