বাংলাদেশের রোল মডেল: উপেক্ষা ও অতিরঞ্জন

প্রতিটি জাতির অগ্রগতি শুধু অর্থনীতি বা প্রতিষ্ঠান নির্ভর নয়, বরং তাদের নৈতিক দিকনির্দেশনাও নির্ভর করে প্রকৃত প্রেরণাদাতা ব্যক্তিত্বদের ওপর। এরা সেই মানুষ, যাদের সাহস, দূরদৃষ্টি ও ত্যাগ তরুণ প্রজন্মকে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং সামষ্টিক কল্যাণে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাদের অবদান সংরক্ষিত হয়, অধ্যয়ন করা হয় এবং যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রেরণাদাতাদের প্রায়ই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে—এক পক্ষ তাদের দেবত্ব দিয়েছে, অন্য পক্ষ আবার অপমান করেছে বা আড়ালে ঠেলে দিয়েছে।

রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক:

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, “লাল মওলানা” নামে পরিচিত, ছিলেন বিরল সেই নেতাদের একজন যিনি কখনও ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভ করেননি। আজীবন দরিদ্র, গ্রামীণ জনতা ও নিপীড়িতদের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। ভাষা আন্দোলন ও ঔপনিবেশিক বিরোধী রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকাও অসামান্য, কিন্তু তার উত্তরাধিকার যথেষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। স্বাধিনতার পর কোন সরকার তার অবদানের সঠিক মূল্যায়ন করেনি।

শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান স্থপতি। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ে লক্ষ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার তার ক্ষমতা ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়। তবে স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ের শাসনামলে (১৯৭২–আগস্ট ১৯৭৫) তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র বিলোপ, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের মতো গুরুতর ভুল করেন।

তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের প্রধান, ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মস্তিষ্ক। দেশপ্রেম, নেতৃত্ব, বিনয় ও কৌশলী চিন্তাভাবনার এক অনন্য মিশ্রণ তিনি বহন করতেন, অথচ রাষ্ট্রীয় বয়ানে তাঁকে ধারাবাহিকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।

জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, ছিলেন শৃঙ্খলা ও সাহসের প্রতীক। তাঁর যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব অতুলনীয় হলেও পাঠ্যপুস্তক ও জনস্মৃতিতে তিনি প্রাপ্য গুরুত্ব পাননি।শেখ হাসিনার শাসনামলে অন্য সকল বীর পূরুষদের অবদান সম্পুর্ণ আড়াল করে কেবল মাত্র শেখ মজিব কে দেবত্ব প্রদান করা হয়।

রাজনীতির বাইরে সৃষ্টিশীল পথপ্রদর্শক

বাংলাদেশের প্রেরণাদাতারা কেবল রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতা নন। নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে লাখো দরিদ্র নারীকে ক্ষমতায়ন করেছেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকা উন্নয়নে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। . জাফরুল্লাহ চৌধুরী গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ উৎপাদনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তবু এদের সবাই রাজনৈতিক শত্রুতা বা রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার শিকার হয়েছেন।

অন্য যাদের নাম জাতীয় সম্মাননায় থাকা উচিত:

  • বেগম সুফিয়া কামাল, কবি ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত।
  • . কুদরতখুদা, বিজ্ঞানী ও শিক্ষা সংস্কারক, যিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
  • জহির রায়হান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক, যার সৃষ্টিকর্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নিপীড়িতদের সংগ্রামকে ধারণ করেছে।
বিকৃতির চক্র ভাঙা

দৃশ্যমান একটি ধারা হলো—বাংলাদেশ রাজনৈতিক সুবিধা অনুযায়ী প্রেরণাদাতাদের সম্মান জানায়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হয়। এতে তরুণ প্রজন্ম সত্যিকারের ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হয়, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও হতাশা বাড়ে।

সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান এই চক্র ভাঙার একটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে—ত্রুটিগুলো আড়াল না করে অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, দলীয় সীমারেখা পেরিয়ে প্রেরণাদাতাদের তালিকা প্রসারিত করা, এবং আগামী প্রজন্মকে সত্য ও ভারসাম্যপূর্ণ ইতিহাস শেখানো।

প্রকৃত প্রেরণাদাতা ছাড়া একটি দেশ যেন লাঠিহীন অন্ধের মতো। বাংলাদেশে এর প্রাচুর্য আছে—প্রয়োজন শুধু তাদের সৎভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সদিচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *