ইতিহাসের শেষ গন্তব্য ও বাংলাদেশের শিক্ষা

ফুকুয়ামার বার্তা: গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে নাগরিক সক্রিয়তা অপরিহার্য

ভূমিকা

১৯৯২ সালে মার্কিন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তার বই The End of History and the Last Man–এ এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন, মানব সভ্যতার দীর্ঘ রাজনৈতিক বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপ হলো উদার গণতন্ত্র—যেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা মিলেমিশে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর আগে আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পতন, আর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সাম্যবাদের ভেঙে পড়া। এর ফলে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শগুলো কার্যত মুছে গেছে।

তবে ফুকুয়ামা সতর্ক করেন—এই সাফল্য স্থায়ী নয়; নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকলে গণতন্ত্র ভেতর থেকেই দুর্বল হয়ে যেতে পারে।


ইতিহাসের ‘শেষ’ মানে কী?

“ইতিহাসের সমাপ্তি” বলতে ফুকুয়ামা বোঝাতে চেয়েছেন—মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদার গণতন্ত্রের সমতুল্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেন,

  • ফ্যাসিবাদ: ১৯৪৫-এ সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত।
  • সাম্যবাদ: সোভিয়েত পতনের মধ্য দিয়ে অকার্যকারিতা প্রমাণ করেছে।

এখনও কিছু দেশে স্বৈরতান্ত্রিক পুঁজিবাদ (যেমন চীন) বা ধর্মীয় শাসন টিকে আছে, কিন্তু বৈশ্বিক রাজনৈতিক মডেল হিসেবে উদার গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব অটুট।


কেন উদার গণতন্ত্র?

ফুকুয়ামা দুটি বড় কারণ দেখান—

  1. অর্থনৈতিক ক্ষমতা
    মুক্তবাজারভিত্তিক অর্থনীতি উদ্ভাবন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে এগিয়ে থাকে। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে, যারা রাজনৈতিক অধিকার ও জবাবদিহি দাবি করে।
  2. মানবিক মর্যাদা
    মানুষ শুধু ভোগ-বিলাস নয়, সমান স্বীকৃতি চায়। উদার গণতন্ত্র আইন, ভোটাধিকার ও স্বাধীনতার মাধ্যমে সেই চাহিদা পূরণ করে।

“শেষ মানুষ”–এর হুঁশিয়ারি

নীটশের ধারনা থেকে নেওয়া “Last Man” ধারণা ফুকুয়ামার বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।

  • বড় রাজনৈতিক সংগ্রাম শেষ হলে মানুষ হয়তো আর কোনো আদর্শ বা ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
  • নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যে ডুবে রাজনৈতিক দায়িত্ব ভুলে যেতে পারে।
  • এই আত্মতুষ্টি গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি স্পষ্ট— ভোটারদের বড় অংশ যদি মনে করে “সবই এক” বা “আমার ভোটে কিছু বদলাবে না,” তবে স্বৈরতন্ত্রের জন্য পথ প্রশস্ত হবে।


বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিকতা

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামো আছে, কিন্তু কার্যকারিতা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, এবং দুর্বল জবাবদিহি—সবই গণতন্ত্রের মান কমিয়ে দেয়। ফুকুয়ামার তত্ত্ব থেকে আমরা কয়েকটি স্পষ্ট শিক্ষা নিতে পারি—

  1. আইনের শাসন ও নির্বাচন সংস্কার
    শুধু ভোট হওয়া নয়, বরং ভোট যেন প্রতিযোগিতামূলক, সুষ্ঠু ও জনগণের আস্থাভাজন হয়—এটি নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না।
  2. নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি
    রাজনৈতিক দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক দলের নয়, নাগরিকদেরও। ভোট দেওয়া, মতামত প্রকাশ, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন—সবই গণতন্ত্রের অংশ। “শেষ মানুষ” মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
  3. অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি
    উন্নয়নের সুফল শুধু ধনী গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ থাকলে অসন্তোষ বাড়বে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রসার গণতন্ত্রের জন্য শক্ত ভিত তৈরি করে।
  4. সহনশীলতা ও সহাবস্থান
    জাতিগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে নয়, বরং সামাজিক সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে।

বাস্তব উদাহরণ

  • সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করে, সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে দিতে পারে।
  • একইসঙ্গে দেখা গেছে, আন্দোলন শেষ হওয়ার পর নাগরিকদের অংশগ্রহণ কমে গেলে পুরনো স্বার্থগোষ্ঠী আবার প্রভাব বিস্তার করে।
  • নির্বাচনী রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের দুই শিবিরের বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে না ওঠা ফুকুয়ামার সতর্কবার্তার সঙ্গে মিলে যায়—মানুষ যদি নতুন কিছু গড়ার ঝুঁকি না নেয়, তবে ইতিহাস একই চক্রে ঘুরে যায়।

উপসংহার

ফুকুয়ামা বলেছেন, উদার গণতন্ত্র হয়তো মানবজাতির রাজনৈতিক বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপ, কিন্তু এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিকে থাকে না। বাংলাদেশে এর মানে হলো—

  • সুষ্ঠু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা,
  • অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা,
  • এবং সবচেয়ে বড় কথা, নাগরিকদের সক্রিয় রাখা।

গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক দলের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না; প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই এটি বেঁচে থাকবে। ইতিহাস হয়তো বড় আদর্শগত লড়াইয়ের দিক থেকে শেষের পথে, কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই প্রতিদিনই নতুন করে শুরু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *