ভূমিকা
লন্ডনভিত্তিক Financial Times (এফটি) সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে, শিরোনাম “Bangladesh’s Missing Billions, Stolen in Plain Sight”
তথ্যচিত্রটি সম্পর্কে এফটি জানায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার—অর্থাৎ আনুমানিক ২৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা—পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিপুল অর্থ কীভাবে দেশে থেকে বাইরে নেওয়া হলো এবং তা ফেরত আনার বাস্তব সম্ভাবনা আছে কি না—এ বিষয়েই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বিক্ষোভকারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে।
তথ্যচিত্রটি শুধু অভিযোগ তুলে ধরেনি, পাশাপাশি কীভাবে অর্থ পাচার হয়েছে, কারা যুক্ত ছিল, এবং অর্থ ফিরে আনার সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।
মূল অভিযোগ ও খুঁটিনাটি
- পাচারের পদ্ধতি
- ‘ওভার-ইনভয়েসিং’ ও ‘আন্ডার-ইনভয়েসিং’ পন্থায় আমদানির কাগজে অত্যधिक মূল্য দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাঠানো এবং রপ্তানির আয়ের কাগজে কম দেখিয়ে প্রকৃত অর্থ ফেরত না আনা;
- হুন্ডি বা হাওলা-প্রথা ব্যবহার করা হয়েছে অবৈধ অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং করতে;
- ব্যাংক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব ও গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপের অভিযোগ আছে, যা কিছু ব্যাংকের বোর্ড ও শেয়ার নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলেছে;
- সম্পত্তি ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা
- যুক্তরাজ্যের National Crime Agency (NCA) ইতিমধ্যেই কয়েকটি সম্পত্তি ফ্রিজ (ফ্রিজিং অর্ডার) করেছে যা অভিযোগ করা হচ্ছে খারাপ উপায়ে আনা অর্থের বিনিয়োগ।
- সালমান এফ রহমান ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে যুক্ত, বিশেষ করে তাঁর ছেলে ও ভাইয়ের নামে লন্ডনের বিভিন্ন বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ফ্রিজ হয়েছে;
- সাইফুজ্জামান চৌধুরী নামে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে প্রায় ৩৫০টি যুক্তরাজ্যের সম্পত্তির মালিক হওয়ার, যার একটি অংশ অবিলম্বে জব্দ করা হয়েছে
- অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবধান ও বিরোধী প্রতিক্রিয়া
- অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু দুর্নীতি নয়, প্রশাসনের স্বচ্ছতার অভাব, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা, ও সংশ্লিষ্ট দفتর-সংস্থাগুলোর ক্ষমতা হ্রাস—এসব মিলিয়ে পাচার ও আত্মসাৎ সহজ হয়েছে।
- তবে দোষের দাবিদাররা অভিযোগ করেছেন যে এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা সাম্প্রতিক সরকারী নীতি পরিবর্তনের অংশ।
পুনরুদ্ধারের চেষ্টাসমূহ ও সংগ্রাম
- অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছেন সম্পদ উদ্ধার ও দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে।
- বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Bangladesh Bank) ও Financial Intelligence Unit-সহ বিভিন্ন বিভাগ ব্যাংকগুলোর অর্থহীন ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে; কয়েকটি ব্যাংকের জন্য “Big Four” অডিটিং সংস্থা নিয়োগ করা হয়েছে $১৭ বিলিয়ন অভিযোগের বিষয়ে।
- যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির সহায়তায়, বহু জায়গায় সম্পত্তি ফ্রিজ ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
- দুর্নীতি দমন সংস্থা, এনজিওগুলোর দাবী যে, শুধু অভিযোগ করলেই হবে না—আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
| বিষয় | চ্যালেঞ্জ | সম্ভাবনা |
|---|---|---|
| প্রমাণ সংগ্রহ | অপরিকল্পিত তথ্য, প্রমাণ মুছে দেওয়া, বিদেশের আইনগত পদ্ধতির জটিলতা | যেসব দেশে আইন ও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানকার সহযোগিতা বাড়িয়ে প্রমাণ সুরক্ষিত করা যায় |
| বিচার প্রক্রিয়া | সময়সাপেক্ষ মামলা, প্রমাণের মানদণ্ডের উচ্চতা, রাজনৈতিক বাধা | সুস্পষ্ট আইন প্রয়োগ, স্বচ্ছ আদালত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকলে মামলা এগিয়ে নেয়ার সুযোগ |
| সম্পদের অবস্থান ও হস্তান্তর | সম্পত্তি ছড়িয়ে থাকা, মালিকানা বিষয়ক জটিলতা, অফশোর কোম্পানির ব্যবহারে তথ্য গোপন থাকা | ফ্রিজিং অর্ডার, নথিপত্র যাচাই, আইনসিদ্ধ কার্যক্রমে সহযোগিতা বাড়লে উদ্ধার সম্ভব |
| রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ | পুরনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠির প্রতিক্রিয়া, জনমত ও রাজনৈতিক চাপ | জনগণের চেতনা এবং ছাত্র আন্দোলন ইতিমধ্যে দৃশ্যমান; নতুন সরকারের উপযুক্ত নীতি থাকলে পরিবর্তন টেকসই হবে |
উপসংহার
“চোখে-চোখে চুরি” তথ্যচিত্র এবং তার ভিত্তিতে প্রকাশিত তদন্তগুলো স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশে শুধু অর্থ পাচার নয়, এর ব্যবস্থাগত ও নীতি-পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে যা এই ধরনের দুর্নীতিকে সহায়ক। যদিও ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের দাবিটি অভিযোগ ও প্রাক্কলন হিসেবে পাওয়া গেছে, সেসব অর্থের পুনরুদ্ধার হবে কি না, সেটা অনেক বেশি নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইন প্রয়োগের দৃঢ়তা, ও রাজনৈতিক volonté বা ইচ্ছাশক্তির ওপর।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক সংস্থাগুলো যদি এসব অনুসন্ধান ও সম্পদ উদ্ধার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে, তাহলে শাসন ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ হবে এবং জনগণ একটি নতুন অধ্যায়ের প্রত্যাশায় থাকতে পারবে। তবে, এই প্রক্রিয়ায় যেন আবার একই ধরনের ক্ষমতার একবিধানবৎ কেন্দ্রীকরণ বা অন্য কোনো দলীয় একনায়কত্ব সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।