গোস্টিতন্ত্র থেকে উত্তরন: উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর করনীয়

একটি প্রকৃত গণতন্ত্রে নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটে জনগণের ইচ্ছা থেকে, যেখানে নেতা নির্বাচিত হয় যোগ্যতা, দক্ষতা এবং জনসেবার প্রতি নিষ্ঠার ভিত্তিতে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। কেন্দ্রীয় থেকে স্থানীয় স্তর পর্যন্ত নেতৃত্বের আসন প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই পরিবারের হাতে ঘুরতে থাকে, যা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের মুখোশে আচ্ছাদিত এক ধরনের রাজতন্ত্র।

গোস্টিতন্ত্র থেকে উত্তরন উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর করনীয়

রাজনীতির এই বংশানুক্রমিক চক্র ভাঙতে হলে দীর্ঘমেয়াদী ও বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি, যার মূল ভিত্তি হতে হবে নাগরিক শিক্ষা। পাওলো ফ্রেইরি তার “পেডাগজি অফ দ্য অপরেসড” গ্রন্থে বলেছেন, শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যা নাগরিকদের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করতে শেখাবে এবং বংশ, দল, অঞ্চল বা গোষ্ঠী নির্বিশেষে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের সক্ষমতা গড়ে তুলবে। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও আজও কোনও রাজনৈতিক দল বা সরকার নাগরিক শিক্ষা বিস্তারে কার্যকর বা দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

রাজনৈতিক তাত্ত্বিক কাঞ্চন চন্দ্র “হোয়াই ইথনিক পার্টিস সাকসিড” এ উল্লেখ করেছেন যে দক্ষিণ এশিয়ায় বংশানুক্রমিক রাজনীতি সামাজিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত, যেখানে ভোটাররা জাতিগত বা পরিবারভিত্তিক নেতৃত্বকে নিজেদের জন্য উপকারী মনে করেন। তিনি যুক্তি দেন যে জাতিগত ভোটদান কেবল অন্ধ আনুগত্য বা অযৌক্তিক পরিচয় রাজনীতি নয়, বরং এটি একটি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত, কারণ ভোটাররা আশা করেন যে তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকলে তারা চাকরি, সম্পদ এবং সরকারি সুবিধা পাবে।

বংশানুক্রমিক রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্বের উত্থান সীমিত হয়ে পরে যার ফলে শাসনের গুণগত মান বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অর্থ ও ক্ষমতা সীমিত কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পরে। জাতীয় নীতিমালা গঠিত হয় ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ রক্ষার জন্য। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেন, এমন পৃষ্ঠপোষকতা ভিত্তিক ব্যবস্থা মেধা ভিত্তিক শাসন প্রণালীকে সরিয়ে দেয় এবং এর স্থলে আনুগত্যের নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা একটি দেশকে অনিবার্যভাবে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও স্থবিরতার দিকে ঠেলে দেয়।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। মানুষ ভেবেছিল, এবার হয়তো সাম্য, দক্ষতা এবং জনসেবার ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হবে। কিন্তু সময়ের সাথে দেখা গেল, আবারও সেই পুরনো পরিচিত মুখগুলিই ফিরে আসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

দেশে নাগরিক শিক্ষার প্রক্রিয়া যত দ্রুত শুরু হবে, জাতি তত দ্রুত এই রাজনৈতিক স্থবিরতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দেবে কে? যেহেতু রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা নিজেই একটি রাজনৈতিক কাজ, তাই এর প্রধান দায়িত্ব রাজনীতিবিদেরই বহন করতে হবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ, সামাজিক কর্মী, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিও দের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হবে।

ইউনিভার্সাল সিভিক এডুকেশন প্রোগ্রাম  বা সার্বজনীন নাগরিক শিক্ষা কর্মসূচী এমন একটি কার্যক্রম, যা সকল নাগরিককে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, মূল্যবোধ ও দক্ষতা প্রদান করে। এটি শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণী, শিক্ষার্থী বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—বরং সমাজের সকল শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।

সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে নাগরিক শিক্ষা বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের মধ্যে সংযুক্ত রয়েছে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক-রাজনৈতিক জ্ঞান এবং সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশের শিক্ষা দেয়া হয়। জার্মানি নাগরিক শিক্ষাকে শুধু বিদ্যালয়ের পর্যায়েই নয়, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও চালু রেখেছে, যাতে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নাগরিকরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় থাকতে পারেন। বাংলাদেশে সার্বজনীন সাক্ষরতা অভিযানের মতোই জরুরি একটি সর্বজনীন নাগরিক শিক্ষা কর্মসূচি, যা সক্রিয় ও সচেতন নাগরিক গড়ে তোলার মাধ্যমে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করবে।

এই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব শেখানো, পাশাপাশি শাসনব্যবস্থা, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ। এই কর্মসূচি চালু হতে পারে বিদ্যালয়-কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে, আবার অনানুষ্ঠানিক উপায়েও—যেমন কমিউনিটি প্রোগ্রাম, গণমাধ্যম প্রচার, নাগরি কর্মশালা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

নবীন ও উদীয়মান রাজনৈতিক দলের জন্য সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রায় অসম্ভব। তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পথ হতে পারে পরোক্ষ কৌশল গ্রহণ। ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় সরাসরি না গিয়ে, বরং তৃণমূলের মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের শিক্ষিত ও সংগঠিত করাই হতে পারে তাদের সর্বোত্তম কর্মপন্থা।

গভীরভাবে প্রোথিত বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে বিপুল সম্পদ, পেশিশক্তি এবং  তৃণমূল নেটওয়ার্ক থাকার কারনে নবীন ও উদীয়মান রাজনৈতিক দলের জন্য সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রায় অসম্ভব। তাই নতুন দলগুলোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হবে একটি “পরোক্ষ কৌশল” গ্রহণ করা।

ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে সরাসরি জড়িত না হয়ে, বরং তৃণমূলের মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের শিক্ষিত ও সংগঠিত করাই হতে পারে তাদের সর্বোত্তম কর্মপন্থা। তবে সর্বপ্রথম নিজেদের দলের ভেতরে একটি গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ পদযাত্রা আরম্ভ করতে হবে।

যদিও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তবে এই ধারাবাহিক জনসংযোগই নবীন দলগুলির জন্য জনগণের আস্থা ও সমর্থন নিশ্চিত করতে পারে, যা ভবিষ্যতে তাদের নির্বাচনী সফলতার পথ তৈরি করবে। একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানুষের মানসিকতায়ও গভীর পরিবর্তন আনবে।

জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। লেখালেখি, টকশো, নাগরিক সমাবেশ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে তারা এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যদিও স্বৈরশাসনের সময় অনেক বুদ্ধিজীবী ক্ষমতাসীনদের তোষণ ও সুবিধাবাদে জড়িয়ে পড়েন, তবুও সমাজে সবসময় কিছু সৎ ও নির্ভীক জ্ঞানী ব্যক্তি থাকেন, যারা চাপ কিংবা প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার করেন না। উদীয়মান রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করা।

১৯৯৬-৯৭ সালে কয়েকটি এনজিও “লোকাল ডেমোক্রেসি এডুকেশন প্রোগ্রাম (এলডিইপি)” বাস্তবায়ন করে। এটি ইউএসএআইডি দ্বারা অর্থায়িত এবং ব্র্যাকের মাধ্যমে সমন্বিত হয়েছিল। তৃণমূল পর্যায়ে এই কর্মসূচি ১২টি জেলায় ডজনখানেক এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল ভোটার শিক্ষার প্রসার ঘটানো। এলডিইপি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল। উদীয়মান রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য নিজেদের এনজিও গঠন করতে পারে। গণতন্ত্র প্রচারে নিযুক্ত এনজিওগুলোকে সহায়তা দেওয়ার জন্য বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্থায়ন প্রদান করে।

স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না। প্রচলিত মিডিয়া ধীরে ধীরে প্রভাবশালী অর্থশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, ফলে নিরপেক্ষ মতামত পরিবেশন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক কর্মী ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে নিজেদের গণমাধ্যম পরিচালনা করতে পারে। এই গণমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে থাকতে পারে স্বতঃঅর্থায়ন বা গণঅর্থায়নে পরিচালিত মুদ্রিত ও অনলাইন সংবাদপত্র, ইন্টারনেটভিত্তিক টিভি ও সংবাদ চ্যানেল এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

নাগরিকদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম, কারণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই শিক্ষাব্যবস্থাই নাগরিক সচেতনতা তৈরির সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। তাই রাজনৈতিক দল, সামাজিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যমের উচিত সম্মিলিতভাবে সরকারের উপর সর্বদা চাপ সৃষ্টি করা, যাতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে নাগরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি দেশের ইতিহাস যেন সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপিত হয়, তাও নিশ্চিত করা।

বংশানুক্রমিক রাজনীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে হলে মানুষের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু ভোটের মাধ্যমে শাসক পরিবর্তন করলেই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উচিত হবে ক্ষমতা দখলের প্রবৃত্তি পরিহার করে নাগরিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। জনগণকে সচেতন ও শিক্ষিত করে একটি সততা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই হতে হবে তাদের মূল লক্ষ্য। যদিও এটি দীর্ঘমেয়াদী  সময়সাপেক্ষ  প্রক্রিয়া, তবুও এই পথ ছাড়া দেশে প্রকৃত রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই মৌলিক ও বৈপ্লবিক উদ্যোগের উপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *