হকার ‘অবৈধ’–বিতর্ক: আসলে কার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে?

বাংলাদেশের শহরগুলোতে হকার উচ্ছেদ এখন যেন নিয়মিত এক নাট্যমঞ্চ—পুলিশ বা সিটি করপোরেশনের অভিযান, ভাঙচুর, আর পরদিনই আবার নতুন করে দোকান সাজানোর চিরচেনা দৃশ্য। মানুষ প্রশ্ন করে: হকাররা কি সত্যিই অবৈধ? নাকি তাদের ‘অবৈধ’ বানানোর যে কাঠামো, সেই কাঠামোই আসলে অন্যায়?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হয় দুই দশক আগের এক বর্ণময় চিন্তাবিদের কাছে—পেরুর অর্থনীতিবিদ হার্নান্দো দে সোতোর কাছে। তিনি মনে করতেন, উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব মূলত সম্পত্তির আনুষ্ঠানিক মালিকানা নিশ্চিত করলেই। তাঁর ভাষায়—ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলেই দরিদ্র মানুষ উঠে দাঁড়াবে, অর্থনীতি গতিশীল হবে।

কিন্তু বাস্তবতা তাঁকে ভুল প্রমাণ করেছে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার জটিল বাস্তবতা

দে সোতো তাঁর ‘বার্কিং ডগ’ উপমায় বলেছিলেন—যেখানে আইনগত দলিল নেই, সেখানেও মানুষের দখল, ব্যবহার ও সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যমে এক ধরনের মালিকানা তৈরি হয়। যেমন গ্রামের মাঠে প্রতিটি কৃষক নির্দিষ্ট এলাকা ব্যবহার করে, এমনকি তাদের কুকুরও এলাকার সীমা নির্দেশ করে।

সমস্যা হলো, শহুরে বাস্তবতা এত সরল নয়। খাসজমি, রেলওয়ে লাইন, পার্কিং স্পেস, ফুটপাত—এই সব জায়গা মানুষ বছরের পর বছর জীবিকার আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এগুলোকে পুরোনো মালিকানার মতো ‘চিহ্নিত’ করে দেওয়া সম্ভব নয়, এবং সরকারি দলিল তৈরির প্রক্রিয়া এতটাই ব্যয়বহুল যে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়।

গবেষণা দেখায়, দে সোতোর ধারণা অনুযায়ী সম্পত্তির কাগজ পেলেই ঋণ পাওয়ার সুযোগ বাড়বে—এমন প্রমাণ নেই। ব্যাংকের কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আয় প্রমাণ, সম্পত্তি নয়। দরিদ্র এলাকার জমিকে ব্যাংকগুলো বন্ধক হিসেবে গ্রহণই করে না।

অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক মালিকানা অনেক সময় দরিদ্রদের জন্য সুযোগের চেয়ে ঝুঁকিই বেশি সৃষ্টি করে। কারণ এতে উল্টো শক্তিশালী গোষ্ঠীর হাতে তাদের জায়গা হারানোর রাস্তাই প্রশস্ত হয়—যা ‘ডাউনওয়ার্ড রেইডিং’ নামে পরিচিত।

ফুটপাত সবার—তাহলে মালিক কে?

একটি ফুটপাত, একটি পার্ক, একটি নদী—সবই যৌথ সম্পদ। ব্যবহার করার অধিকার মানুষের, নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। এই নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়া কিংবা একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই মূল সমস্যা।

একজন হকার যদি দিনের কিছু সময় ফুটপাতের এক কোণে দোকান লাগান, তাঁর ব্যবহারে হয়তো হাঁটার পথ সরু হয়। কিন্তু একজন শিল্পপতির ইটভাটা, একজন ব্যবসায়ীর দূষণ, অথবা সরকারি প্রকল্পে পার্ক দখল—এসবই তো একই যৌথ সম্পদের ব্যবহার, এবং ক্ষতি তুলনামূলকভাবে বহু গুণ বেশি।

ফুটপাত দখল নিয়ে রাষ্ট্র যতটা কঠোর, বন–নদী দখল নিয়ে ততটা নীরব—এটাই সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য।

হকার কেন আবার ফিরে আসে?

উচ্ছেদের পরদিনই ভয়ঙ্কর দৃশ্য—সেই একই জায়গায় আবার কেউ দোকান সাজিয়েছেন। এর মানে হলো:

  • হকার আছে কারণ চাহিদা আছে
  • তাদের সরিয়ে দিলে সেই চাহিদা মরে না
  • স্থান দখল করে অন্য কেউ ব্যবসা করতে আসে
  • এবং তাদের জায়গা পেতে হয় আরও বেশি চাঁদা দিতে

তাহলে ‘অবৈধ’ কে—হকার, নাকি যে ব্যবস্থা তাকে অবৈধ ঘোষণা করে আবার টাকা নিয়ে ফিরিয়ে আনে?

সামাজিক চুক্তি বনাম রাজনৈতিক সুবিধা

হকাররা যেখানে বসেন, সাধারণত সেখানে বছর ধরে অদৃশ্য সামাজিক চুক্তি তৈরি হয়েছে—খদ্দের আছে, ছাত্র আছে, শ্রমিক আছে, বাসস্ট্যান্ড আছে। সরকার চাইলে এদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা, লাইসেন্স, সময়—সবকিছু সুসংগঠিত করতে পারে। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, সিউল—সব শহরেই এভাবে করা হয়।

সিঙ্গাপুর তো হকারসংস্কৃতিকেও ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে

  • পরিকল্পনা নেই,
  • সংরক্ষণের নীতি নেই,
  • অংশগ্রহণমূলক নগরায়নের সুযোগ নেই,
  • কিন্তু আছে হঠাৎ অভিযান, বুলডোজার আর ভয়।

দরিদ্র মানুষ কি শুধুই রাষ্ট্রীয় শাসনের সবচেয়ে সহজ টার্গেট?

‘অবৈধ’ শব্দের রাজনীতি

নির্বাচনের সময় হকারই হয়ে ওঠেন ভোট-আকর্ষণের হাতিয়ার—তাদের টং দোকানে বসে চা খেয়ে প্রার্থীরা ছবি তোলেন। তারপর আবার উচ্ছেদ অভিযানে একই লোকদের ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হয়।

বৈধতা–অবৈধতার এই রাজনীতি আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করে?

  • হকারের?
  • না, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের?
  • না, সরকারি প্রকল্পের?
  • না, ক্ষমতাসীন রাজনীতির?

যে দেশে ভোটের আগের ‘বৈধ’ আর ভোটের পরের ‘বৈধ’ ভিন্ন—সেখানে হকারদের অবৈধ মনে করার মধ্যে কোনো নৈতিকতা নেই।

শেষ কথা: হকার অপরাধী নয়—সমস্যা হলো নীতিহীনতা

হকাররা শহরের সবচেয়ে দুর্বল অংশ—কিন্তু একই সঙ্গে শহরের অর্থনীতি চালানো মানুষেরাও তারা। তারা দরিদ্র, কিন্তু অপরাধী নয়। তাদের ‘অবৈধ’ বলা হয় কারণ তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করা সহজ।

শহরকে সাজাতে হলে, প্রথম কাজ হওয়া উচিত যৌথ সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার ও অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা।
উচ্ছেদ নয়—সমাধান চাই।

হকার উচ্ছেদের সাফল্য বুলডোজারে নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক নগরনীতিতে। দরিদ্র মানুষের জীবিকা কেড়ে নিয়ে কোনো শহর কখনো সভ্যতার উদাহরণ হতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *